শহীদ মিনারটি হামিদুর রাহমানের কৃতিত্বে প্রশংসিত কিন্তু এর মূলে আরো দুজন ছিলেন। এঁরা হলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ, যিনি এদেশের প্রথম ভাস্কর এবং ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃত্ আর জাঁ দেলোরাঁ নামে একজন ওলন্দাজ স্থাপতি যিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সহকারী স্থপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক স্থপতি এবং স্থাপত্য পেশার পথিকৃত্ মাজহারুল ইসলামের কাছ থেকে জানা যায় যে, নকশার আন্তর-ধারণাটি প্রথমে শিল্পী হামিদুর রাহমানই করেছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদের সঙ্গে। তিনিও তখন সদ্য বিদেশ থেকে আসা একজন সরকারি স্থপতি। একদিন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ তদানীন্তন সরকারের প্রধান স্থপতি ম্যাকোনেলের কাছে হামিদুর রাহমান তাঁর মূল ভাবনা নিয়ে হাজির হন যাতে করে তিনি সেটিকে স্থাপত্য রীতিতে রূপান্তর করায় সাহায্য করেন। স্থপতি ম্যাকোনেল তখন সহকারী স্থপতি জাঁ দেলোরাঁকে সেই কাজে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। এইভাবে শহীদ মিনারটি তৈরি হয়। তবে মূল কাজের অনেক কিছুই হতে পারেনি। যেমন নভেরা আহমেদের করা বাংলা অক্ষরসমূহের লোহার রেলিং ছিল, তা করা হয়নি। ঈষত্ নত হওয়া কংক্রিটের স্তম্ভের ভেতরে রঙিন কাচের কাজ ছিল, তার বদলে জেলখানার প্রতীকে লোহার শিক দেয়া হয়েছে। অনেকে ওই বাঁকানো স্তম্ভগুলোকে মায়ের প্রতীক, কেউ বলেন ফাঁসিকাঠ, কেউ আবার শহীদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যে মাথা ঝুঁকে শোক প্রকাশের কথা বলে মনে করেন। তবে সেই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উঁচু শিল্পমানের কাজ ছিল স্তম্ভের নিচেকার ভূগর্ভস্থ জাদুঘরের দেয়ালে চিত্রিত রঙিন দেয়ালচিত্র। শিল্পী ছিলেন হামিদুর রাহমান। আধা-বাস্তব, আধা-বিমূর্ত ঘনকবাদী রীতির সেই রঙিন চিত্রাবলি মূলত ভাষা আন্দোলনের সময়ের ছাত্র-মিছিল, পোস্টার, বাংলা অক্ষর, পুলিশের গুলিছোড়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে খুব আকর্ষণীয় এবং শিল্পগুণ সম্পন্ন কাজ ছিল। সাধারণত বহুদিন যাবত্ ঘরটি বন্ধ ছিল, দর্শকদের দেখতে দেয়া হতো না, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। ফলে যত্ন ও সংস্কারের অভাবে শিল্পকর্মটি নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের শিল্পের জন্য এটি একটি অপূরণীয় ক্ষতি একথা স্বীকার করতেই হয়। পরে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বর্বর পাকসেনারা কামান দেগে শহীদ মিনারটিকে ধ্বংস করে। এরপরে স্বাধীনতার পর এটিকে পুনর্নির্মাণ করার কথা ওঠে। তখন ছিল জাতির প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমল। ঠিক হলো এই পুরনো ধ্বংসস্তূপ রেখে তার ওপর নতুন নকশার নতুন শহীদ মিনার হবে আধুনিক প্রযুক্তি, বসার ব্যবস্থা, শব্দ-আলো ব্যবস্থাসহ। সেইমতো একটি প্রতিযোগিতাও শুরু হয় সারা দেশজুড়ে। দেশের প্রায় সব স্থপতি সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সেখানে হামিদুর রাহমানও তাঁর পুরনো নকশা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামেন। কিন্তু ফল প্রকাশের আগে, প্রায় ১৫টি নতুন নকশা জমা হওয়ার পরেও সাব্যস্ত হলো যে নতুন নকশা এখানে হবে না। তার বদলে আবারো সেই হামিদুর রাহমানের নকশা মনোনীত হলো এই কারণে যে, যে নকশা বহুদিন যাবত্ ব্যবহূত হতে হতে বা দেখতে দেখতে মানুষের কাছে একটি পবিত্র প্রতীক হয়ে গেছে, সেটিকে আর পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। জয়নুলের সেই বিখ্যাত উক্তি সেই সময়ের—মা যদি কালো বা কুিসত হয়, তাহলে তাকে কি বাদ দিতে হবে?