• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৪:২১ অপরাহ্ন

সভ্যতার সংকটের আরেক রূপ

আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

যা কিছু জীবন-যাপনের অংশ হয়ে যায় সেসব নিয়েই মানুষের সংস্কৃতি। এই সত্য প্রাগৈতিহাসিক যুগেও ছিল, এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতেও বাস্তবতা। বিবর্তনের ধারায় সংস্কৃতির অগ্রগতি হলে জীবন-যাপনের মান শুধু বৃদ্ধি পায় না, নতুন মূল্যবোধেরও সৃষ্টি হয়— যার ভিত্তি সামষ্টিক জীবনের বিস্তৃতি। এই মূল্যবোধ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং কল্যাণকর না হয়ে তার বিপরীতও হতে পারে, যা প্রায় অবিশ্বাস্য। নারী মুক্তি, স্বাধীনতা ও পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সংস্কৃতির অগ্রগতি সভ্যতার সূচনা করেছে। গুহাবাসী মানুষের জীবনে নর-নারীর ভূমিকা ও অধিকার ছিল সমান। কৃষি সংস্কৃতির উত্তরণের পরও কিছুকাল মানুষের সামষ্টিক জীবনে পুরুষের সঙ্গে মেয়েরা পালন করেছে একই দায়িত্ব এবং উপভোগ করেছে একই অধিকার। বিবাহের ভিত্তিতে পরিবার প্রথার প্রচলন এবং উত্পাদনের নতুন প্রযুক্তি সভ্যতার আবির্ভাবে নর-নারীর মধ্যে শ্রেণিভেদ সৃষ্টি করেছে শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থানের অবনতিকে ত্বরান্বিত করেছে রাজনীতি এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি। সব ক্ষেত্রেই পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার পর মেয়েরা পুরুষের সমান হবার অধিকার হারিয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতির উন্নতি এবং সভ্যতার বিকাশে নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ হয়েছে অন্তঃপুরে। এই পতনকে ইতিহাসের পরিহাসই বলতে হবে, কেননা আদিম সমাজে নারী-পুরুষের যে সমতার সম্পর্ক ছিল সভ্যতার সূচনায় তার ভাঙন এবং তিরোধান বেশ বিস্ময়কর। যে-সভ্যতার উন্মেষে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অবদান ছিল দীর্ঘকাল, সেই সভ্যতাই নারীর অধিকার হরণ করে পুরুষের অধীনস্থ করে রাখবে— এর পেছনে গ্রহণযোগ্য যুক্তি পাওয়া কঠিন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্থানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের উদ্ভব নর-নারীর যৌথ প্রয়াস কিংবা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে হয়নি। ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পুরুষরা ক্ষমতা ব্যবহার করেই সমাজে নারীর ভূমিকা ও অধিকার নির্ধারণ করেছে। প্রশ্ন হলো নারীরা কেন পুরুষের মতো একইভাবে ক্ষমতার অধিকারী হলো না। একদিকে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং উত্পাদন ব্যবস্থার জটিলতা যেমন মেয়েদের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মেয়েদের সন্তান প্রসব ও তাদের লালন-পালনের দায়িত্বভার বেড়ে যাওয়ায় পুরুষের সঙ্গে আগের মতো বাইরের কর্মজীবনে সর্বক্ষণের সহযোগী হিসেবে একই ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকার সুযোগ হারিয়ে গেল। কৃষি সংস্কৃতির অধীনে বিভিন্ন জনপদের মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ নারীর ভূমিকা আরো সঙ্কুচিত করে অন্তঃপুরবাসিনী করে তুলেছিল। একচ্ছত্র ক্ষমতা অর্জন করার পর মেয়েদের তার অংশীদার করার কথা মনে এলো না পুরুষের। মনে এলেও ক্ষমতার নিরঙ্কুশ ব্যবহারের লোভ নেশার মতো পুরুষের জন্মগত স্বভাব হয়ে গেল। সেই থেকে পুরুষশাসিত সমাজের মেয়েদের অধিকার হারানোর শুরু এবং অবহেলার সূত্রপাত। যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণের সংস্কৃতির সূচনা পুরুষের মূল্যবোধের এই পরিবর্তনের সময় থেকেই। সমাজ যেহেতু পুরুষশাসিত, অতএব সামাজিক মূল্যবোধ বলতে যা সৃষ্টি হলো সেসব পুরুষেরই অভিরুচি এবং স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ থেকে নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রথমে বিরোধিতা এবং পরে কাগজে-কলমে মেনে নিলেও দৈনন্দিন জীবনে মেয়েদের ক্ষমতায়ন ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা দুরূহ হয়েই থাকলো। আইন পাস করে বা নিয়ম প্রবর্তন করে দীর্ঘকালের জেন্ডার বৈষম্য দূর করা পাশ্চাত্যের উন্নত দেশেই আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। একই কাজের জন্য যেসব দেশে মেয়েরা পুরুষের সমান বেতন পায় না তাদের উন্নতির ক্ষেত্রেও কাজ করে নানা প্রতিবন্ধকতা যাকে গ্লাস সিলিং বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও দুর্ভেদ্য।

অসম ক্ষমতা ও সুযোগের অধিকারী যারা তারা দুর্বল শ্রেণির প্রতি ন্যায়সম্মত ব্যবহার করার তাগিদ অনুভব করেন না। নারী আন্দোলন সফল হয়েও মেয়েরা প্রকৃত ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবার কারণে পুরুষের শোষণের শিকার হয়। শোষণের নিয়মিত প্রকাশ ঘটে কর্মস্থলে যৌন হয়রানিতে, বাড়িতে নির্যাতনে এবং বাইরে কখনো ধর্ষণে। এই সব অবমাননা এমন যে ভুক্তভোগী মেয়েরা লোক-লজ্জায় মুখ খুলতে ইতস্তত করে। শুধু ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবার আশঙ্কা নয়, চাকরি হারানোর এবং চরিত্র হননের আশঙ্কাও কাজ করে নিশ্চুপ এবং প্রতিবাদহীন হয়ে থাকার পেছনে। কিন্তু এমন সময় আসে যখন ধৈর্যের ও সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় এবং লোক নিন্দার ভয়ে গোপনে না রেখে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে ভদ্রবেশী ক্ষমতাধর পুরুষের জঘন্য কার্যকলাপের বিবরণ।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন সেই সময় একের পর এক নারী তার হাতে যৌন নির্যাতন ও হয়রানির উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে। ট্রাম্প মোটেও লজ্জিত বা বিব্রত না হয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে মেয়েদের ওপর তার আধিপত্যের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন যে, পুরুষদের ক্ষমতা আছে বলেই তারা এমন ব্যবহারের অধিকারী। পুরুষশাসিত সমাজ এমন যৌন হয়রানি বা নিপীড়নকে স্বাভাবিক বলে মনে করে বলেই তার স্বীকারোক্তির জন্য নির্বাচনে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় কোনো ধস নামেনি। সম্প্রতি আমেরিকার রাজনীতিবিদসহ অভিনেতা, চিত্র প্রযোজকরা একের পর এক নারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। ঘটনার বেশ দীর্ঘকাল পরই মেয়েরা সাহস করে এগিয়ে এসে তাদের মুখ খুলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করেননি সাহসের অভাবে, গণমাধ্যমের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়া যাবে এমন নিশ্চিয়তার অভাবে। আমেরিকার গণমাধ্যম এখন রীতিমত এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় নির্যাতিতা অপমানিতা মেয়েরা সাহস পেয়েছেন এবং পুরনো অভিজ্ঞতা অভিযোগের আকারে প্রকাশ করছেন। শুধু আমেরিকা নয় ইংল্যাণ্ডেও উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে প্রায় একই সময়ে। মনে হচ্ছে অদৃশ্যে থেকেই নির্যাতিতা মেয়েরা নিজেদের একটি অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন যার অধীনে তারা এখন প্রতিশোধ নেবার জন্য সোচ্চার। এই সব অভিযোগ ক্ষমতাধরদের মুখোশ খুলে দিলেও যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের অবসান হবে না যদি না পুরুষদের মূল্যবোধ ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে এবং মেয়েদের তারা সম-অধিকারী হিসেবে মর্যাদা দিতে শেখে। কারো কারো মধ্যে এই পরিবর্তন আসবে স্বেচ্ছায়, অন্যদের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হবে লোকলজ্জার আশঙ্কায়।

পুরুষদের মূল্যবোধের বা মাইন্ড সেটের পরিবর্তন সাধনে মেয়েদের ভূমিকাই হবে প্রধান। তাদেরকে সাহস করে লোকলজ্জার ভয়ে সঙ্কুচিত না হয়ে এগিয়ে আসতে হবে নিপীড়ন, নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই। সময়োচিত অভিযোগের সত্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকবে না। অধিকার আদায়ের জন্য তারা যেমন নারীবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল, নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধেও একই ধরনের সংঘবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।

পাশ্চাত্যের মেয়েরা লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে উঠেছে বলেই একের পর এক ক্ষমতাধর পুরুষের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যের সভ্যতার এক অন্ধকারময় দিক উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে বিশ্বব্যাপী। উন্নয়নশীল দেশে মেয়েরা সদ্য কিছু অধিকার লাভ করেছে, ক্ষমতার ছিটেফোঁটা ভোগ করছে। তারাও কর্মস্থলে, পথে-ঘাটে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে কিন্তু লোকলজ্জার আশঙ্কায় এবং বখাটেদের ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। বাংলাদেশে কিংবা ভারতে অনেক ধর্ষণের ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গিয়েছে। এদের অধিকাংশই হয় লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে কিংবা ধর্ষকরাই ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। ধর্ষকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য অথবা রাজনৈতিক দলের প্রটেকশন পাবে বলে মনে করে বলে বেপরোয়া হয়। অন্যদিকে ধর্ষিতারা প্রায় ক্ষেত্রেই দরিদ্র পরিবারের হওয়ার জন্য কোনো সাহায্য পাবে না মনে করে হয় নিশ্চুপ থাকে নতুবা আত্মঘাতী হয়। যেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ আনা হয়, সেখানে তদন্ত প্রায়ই সাক্ষীর অভাবে অথবা প্রভাব খাটানোর জন্য কোর্ট পর্যন্ত যায় না। যৌন হয়রানির প্রকৃত সংখ্যা ভুক্তভোগীদের লোকলজ্জার ভয়ে গোপন রাখার কারণে জানা না গেলেও এর প্রকোপ যে বাড়ছে তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানি অভিযোগ শোনা গিয়েছে। তারা যে সাহস করে এগিয়ে আসছে নিপীড়কদের মুখোশ উন্মোচনে তার পেছনেও কাজ করছে মেয়েদের অদৃশ্য সামাজিক নেটওয়ার্ক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্ষণের ঘটনা। স্কুল বা কলেজ থেকে ফেরার পথে মেয়েদের নিয়মিতভাবে বখাটেদের হয়রানির মুখোমুখি হওয়া অথবা কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে দরিদ্র পরিবারের কর্মজীবী মেয়েদের একই অভিজ্ঞতা ধর্ষণের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় কারো কারো ক্ষেত্রে। পুরুষশাসিত সমাজে দরিদ্র মেয়েরা বিচার পায় না বলেই যেন ধর্ষকরা বেপরোয়া হয়ে তাদের পাপের ক্ষুধা মেটাতে ইতস্তত করে না বিন্দুমাত্র। ধর্ষণ করেই তারা ক্ষান্ত হয় না, অনলাইনে ছড়িয়ে দেয় ধর্ষিতার চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে। মনে হয় সভ্যতার উন্মেষ থেকে এখন পর্যন্ত প্রযুক্তি মেয়েদের বিরুদ্ধেই ব্যবহূত হচ্ছে। ভাষার উপর দখল প্রতিষ্ঠা করা যেমন নারী মুক্তির অন্যতম শর্ত, প্রযুক্তিকেও নারীর উপযোগী করে তুলতে না পারলেও তাকে জেন্ডারনিরপেক্ষ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আরো বেশি প্রয়োজন এমন প্রযুক্তির উদ্ভাবন যা নারী নির্যাতনকারী এবং ধর্ষকদের মুখোশ উন্মোচিত করতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নে আর্থিক স্বাধীনতাই যে যথেষ্ট নয় তা অনেক দিক থেকেই বোঝা যাচ্ছে। আইন দিয়েও এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। সভ্যতার সূচনায় নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনই নারীদের ক্ষমতায়ন এবং অধিকার হরণ করেছিল। বর্তমানের সংকটে প্রযুক্তিকেই তার ভুল সংশোধন করে নারীর জীবন, সম্মান এবং অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এ হবে এমন প্রযুক্তি যাতে ভুক্তভোগী নারীকে হয়রানি বা ধর্ষণের অভিযোগ এনে প্রমাণের জন্য প্রকাশ্যে সবার সামনে উপস্থিত হতে হবে না। ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে বাস করে এমন আশা করা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখার মতো হবে না নিশ্চয়। যৌন হয়রানি আর ধর্ষণের কলঙ্কিত সংস্কৃতির অবসান না ঘটাতে পারলে তাকেই বলতে হবে বর্তমান সভ্যতার সংকট। যে যুগে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হয় যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে তাকে সভ্য বলা হলে সভ্যতারই অপমান করা হবে।

লেখক: কথাশিল্পী ও সাবেক সচিব


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ