মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডটি আজও রহস্যের ঘেরাটোপে আবদ্ধ। সম্প্রতি এই রহস্যজট উদ্ঘাটনের বিষয়টি যাচাইয়ের লক্ষ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ প্রদান করেন। আদেশ অনুযায়ী নিয়োগকৃত একজন এমিকাস কিউরি বিষয়টির তদন্ত করবেন। বিভিন্ন যৌক্তিকতার বিশ্লেষণে বলা যায় অবশ্যই এ রায়টি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশেষত, হত্যাকাণ্ডটি কীভাবে এবং কেন ঘটেছে—এ দুটি বিষয় স্পষ্ট করাই এ ক্ষেত্রে মুখ্য বলে প্রতীয়মান হয়। উপরন্তু মামলার অভিযোগেও বিষয় দুটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মামলার বাদী ‘অভিনব ভারত’-এর ট্রাস্টি পঙ্কজ ফাদানিস উক্ত মামলায় অভিযোগ করেন যে, হত্যাকাণ্ডটির সঙ্গে বৈদেশিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। যদিও অভিযোগটি এখনো প্রমাণিত হয়নি।
তবে আমি স্মৃতিচারণ করে একটি ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি যে, এ হত্যাকাণ্ডটিতে যথেষ্ট নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল। তখন (হত্যাকাণ্ডের সময়) আমি উর্দু দৈনিক ‘আনজাম’-এর নিউজ ডেস্কে কাজ করতাম। সেই সময় একদিন আমি সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের টেলিপ্রিন্টারের আওয়াজ শুনতে পাই। যদিও তারা কদাচিত্ আমাদেরকে সংবাদ পাঠাত। তাই আমি ডেস্ক ছেড়ে এক লাফে গিয়ে প্রতিবেদনটি পড়ি। কিন্তু তাতে শুধু একটি মাত্র বাক্যই লেখা ছিল। তা হলো, ‘মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করা হয়েছে।’ এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আমি তখন আমার এক সহকর্মীকে মোটর সাইকেলযোগে হত্যাকাণ্ডের স্থান ‘বিড়লা হাউজ’-এ পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পৌঁছেও যাই। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে আমি বাস্তবিক অর্থেই নিরাপত্তার ঘাটতি দেখতে পাই। দেখি, দরজায় দাঁড়িয়ে তখন শুধু একজন ব্যক্তি দুঃখ প্রকাশ করতেছে।
কিন্তু আজ, সেই দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অনেককেই মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে শোক প্রকাশ করতে দেখা যায়। তাই সকলের জ্ঞাতার্থে বলছি, গান্ধী যে সেসময় চরমপন্থী একদল হিন্দু কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারেন—এ ব্যাপারে তত্কালীন সরকারের নিকটও যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছিল। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এমন পরিস্থিতিতেও তাঁর জন্য যত্সামান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছিল।
অথচ ঘটনার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেও উগ্রপন্থী দলের মদনলাল গান্ধীজীর প্রার্থনাকক্ষের প্ল্যাটফর্মের পিছনে বোমা স্থাপন করেছিল। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো—আমি প্রায়শই এই প্রার্থনা সভায় উপস্থিত থাকতাম। এমনকি বিস্ফোরণের দিনও আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তখন আমি একটি বিষয় খুব গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করলাম। তা হলো—এতবড় একটি দুর্ঘটনা ঘটার পরও তিনি নিঃসঙ্কোচেই তাঁর প্রাত্যহিক প্রার্থনা সম্পন্ন করলেন। উপরন্তু তাঁর ভাবখানাও এমন ছিল যে, ক্ষণকাল পূর্বে আসলেই এখানে খারাপ কিছু ঘটেনি। এমতাবস্থায় আমি নিজেও বিষয়টিকে একটি পটকা ফাটার মতো ঘটনা হিসেবে ভাবতে শুরু করলাম। কিন্তু যখন আমি পরের দিনের সংবাদপত্র পড়ি, শুধু তখনই বুঝতে পারি যে গান্ধীজী সেসময় কতটা মৃত্যুর সন্নিকটে ছিলেন।
এই ঘটনায় তখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার প্যাটেল নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু তখন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাকে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার পরামর্শ দেন। তিনি তখন তাকে গান্ধীজীর একটি অর্পিত দায়িত্বের কথা জানান। তিনি বলেন, গান্ধীজী চেয়েছিলেন, তারা দু’জন যেন ভারতকে আধুনিক একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলেন। এমনকি আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
এরই ধারাবাহিকতা হিসেবে সেই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে হিন্দুদের অধিকার কতটা রক্ষিত হচ্ছে—এ বিষয়েই অধিক মনোযোগী হতে দেখা গেছে। যদিও সেসময় হত্যাকাণ্ডটির রহস্য উদ্ঘাটন করা সবচেয়ে জরুরি ছিল। কিন্তু এর পরিবর্তে সেসময় সরদার প্যাটেলকে এমন মন্তব্য করতেও শোনা গেছে যে, আরএসএসের সৃষ্ট এমন পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক ছিল না। যাই হোক, ১৯৫৫ সালে যখন আমি তথ্য অফিসার হিসাবে যোগদান করি, তখন আমি এ ব্যাপারে নানা সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেখানে আমার চাকুরি জীবনের প্রায় ১০ বছরেও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো আলামত খুঁজে পাইনি। তবে একটি ব্যাপার নিশ্চিত হয়েছি যে, পাছে মামলাটি যাতে যথাযথভাবে সমাপ্ত না হয়, সেজন্য সেখানে সর্বত্রই তথ্য গোপনের একটি জঘন্য প্রবণতা রয়েছে। অন্যথা খোদ সরকারও চাচ্ছিলেন না যে, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য প্রকাশিত হোক। হয়তো-বা তাতে এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সরকারের কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততা প্রকাশ হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল।
আদৌ ভারতের আর্কাইভ কর্তৃপক্ষ এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত কোনো দলিলপত্র হস্তান্তরের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়নি। কিন্তু ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার দুই তিন বছরের মধ্যে তাদের নিজেদের মতো করে প্রকাশিত তিন খণ্ডের একটি পুস্তিকায় এ ব্যাপারে হালকা কিছু রেখাপাত করেছে মাত্র।
তবে মহাত্মা গান্ধী হত্যার অল্প কিছুক্ষণ পর যখন আমি বিড়লা হাউজে পৌঁছালাম, তখন এমন কিছু বিষয় প্রত্যক্ষ করেছি, বস্তুত যা ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত দেয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—গান্ধীজীর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহটি যেখানে পড়েছিল, এর আশেপাশে কোনো রক্ষী ছিল না। সেসময় আমি প্রার্থনার প্লাটফর্ম বেয়ে তাঁর তাজা রক্ত গড়িয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে এই রক্ত সংরক্ষণের জন্য আমি সেখানে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখতে পাইনি।
যাই হোক, আবারও বর্তমান প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি প্রত্যক্ষ করছি যে, হাল আমলেও এ হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বিধিবাম। বস্তুত সাম্প্রতিক কালের কোনো সরকারই এ ব্যাপারে পুরনো এসব গুরুত্বপূর্ণ আলামতকে আমলে নিতে চান না। এক্ষেত্রে আমি বিজেপির দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কোনো অবস্থাতেই দলটি চায় না যে এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শদাতা আরএসএসের কোনো সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসুক। কিংবা অতীতের কোনো প্রমাণযোগ্য বিষয় পুনরায় সামনে আসুক। কিন্তু কংগ্রেসের তো এ ব্যাপারে বহু আগে থেকেই আদা-জল খেয়ে নামা উচিত ছিল।
তথাপি কংগ্রেসের দীর্ঘ ইতিহাসে এর প্রতিফলন কদাচিতই দেখা গেছে। এমনকি গান্ধীজী হত্যার পর তাঁর অনুসারীদের যে পরিস্থিতি ভোগ করতে হয়েছিল, বোধ করি আজও তাদের অবস্থা একই আছে। বরাবরের মতো আজও সরকার তাদেরকে বিরুদ্ধশক্তি হিসেবেই মনে করে। উপরন্তু ক্ষমতার দোলাচলে বিজেপির কিছু বেপরোয়া ভাবও লক্ষ্য করার মতো।
তবে এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, গান্ধী হত্যাকাণ্ডের সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। তথাপি একটি সংশয়ের মীমাংসা আজও হয়নি। তা হলো—এমন একজন ব্যক্তির গুপ্তহত্যার পরও কেন কোনো পুলিশ ঘটনাটির গ্রহণযোগ্য আলামত সংগ্রহ করেনি? তবে একথা সত্য যে, সেসময় কিছু হিন্দু উগ্রবাদী গ্রেপ্তার হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমি মনে করি, নাটকের এ মঞ্চটি আরো প্রশস্ত ছিল। এতে উচ্চপর্যায়ের বহু লোক জড়িত থাকতে পারে। তা ছাড়া মালেগাঁওয়ের বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত স্বামী অসীমানন্দের স্বীকারোক্তি থেকেও একথা স্পষ্ট হয়েছিল যে, হিন্দু চরমপন্থীদের নেটওয়ার্ক যথেষ্ট বিস্তৃত। সুতরাং গান্ধীজী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু নয়।
পাকিস্তান টুডের ওয়েবসাইট থেকে অনুবাদ : মো. সহিদুল ইসলাম
n লেখক :প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী