• শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ন

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের নেপথ্যে

আপডেটঃ : সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

হেমন্তের হালকা কুয়াশাভেজা ভোরে সবুজ গাছগাছালির ফাঁকে সর্পিল গতিতে এঁকেবেঁকে চলা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে শিশিরবিন্দুর মুক্তাজড়ানো লজ্জাবতী গাছের পাতায় হাত বুলাতে গিয়ে ঝরে-পড়া বিন্দুগুলোর মায়াভরা চাহনি মনটাকে কী অপূর্ব রঙে রাঙিয়ে দেয়। আগের দিনের টেনশনের বিষয়গুলো মুহূতের্র জন্য ভুলে যাই। কিন্তু কয়েকদিন ধরে মনের ভেতরের পাখা-ছড়ানো রঙগুলো ধূসর হয়ে যাচ্ছে, মনটা ছোঁয়ালাগা লজ্জাবতীর পাতার মতো কুঁকড়ে যাচ্ছে। লাজ নেই তবুও গাছ লজ্জাবতী, একটুতেই কুঁকড়ে যায়। কিন্তু আমার তো লাজ আছে, এ লাজ তো আমি লুকাতে পারি না। এ লাজ শিক্ষক হওয়ার লাজ। গর্ব করে এখন নিজেকে শিক্ষক পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করি। ভয় পাই, যদি কোনো শিক্ষার্থী জিজ্ঞেস করে বসে: আপনি তো শিক্ষক, আপনিও কি প্রশ্ন ফাঁস করেন?

জগিং শেষে ঘরে ফিরে সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখি, কোনো না কোনো পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে—প্রাথমিক সমাপনীতে অথবা মাধ্যমিক পরীক্ষায় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আরেক ফাঁস রোগ, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস। একেবারে ষোলকলায় পূর্ণ। ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে ‘ভালো’ ফল ‘অর্জন’ করবে। এ ভালো ফলে ‘বিচি’ থাকবে না বিধায় এটিতে কখনো অঙ্কুরোদগম হবে না। আর তাই নিরুপায় হয়ে ভালো ফলধারী আমার ছেলে বা মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে নগদ অর্থের সাথে অরিজিনাল সনদপত্র. মার্কসীট ইত্যাদি জমা দিয়ে স্পেশাল ডিভাইস পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াবে। এ সুযোগে শহরটাও দেখা হয়ে যাবে, ডিভাইসও মিলে যাবে যা দিয়ে সহজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরগুলো মৃদুমন্দ তরঙ্গের সাথে ইথারে ভেসে তরতর করে তার কানে পৌঁছে যাবে। আহা, কী আনন্দ! গবেট হওয়া সত্ত্বেও আমার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাবে। মহাসুখে ক্লাস করতে থাকবে। যখন সেমিস্টার ফাইনালের সময় আসবে তখন বিমূঢ় হয়ে দেখবে আমার প্রিয় সন্তান সঠিক বিদ্যার অভাবে ক্লাসে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। তখন বাধ্য হয়েই সে ছুটবে প্রশ্নের সন্ধানে। যেভাবে চলছে সেভাবে চললে প্রশ্ন পেয়েও যাবে। সুতরাং ডিগ্রি তার আটকায় কার বাপের সাধ্য? তার বাপই যখন তাকে আটকায়নি তখন অন্যের বাপের কী ঠ্যাকা লেগেছে তাকে আটকানোর? ডিগ্রি নিয়ে সে যাবে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে, সেখানেও তো কোনো সমস্যা থাকবে না, পেয়ে যাবে কোনো সিবিএ নেতা থেকে একটা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন। লাগবে শুধু কিছু টাকা। অবশ্য অর্থ না-ও লাগতে পারে যদি প্রশ্ন ফাঁস করা হয় শুধুই কোনো চক্রান্ত বা সাবোটাজের অংশ হিসেবে। আমার অযোগ্য ছেলেটি ফাঁস-করা প্রশ্নের বরকতে চাকরিতে যোগদান করবে। এবার শুরু হবে আসল পরীক্ষা যেখানে ফাঁস-করা প্রশ্নের কোনো ভূমিকাই থাকবে না। যেহেতু তার বিদ্যা নেই, সেহেতু চাকরির কাজটি আর করতে পারবে না। আক্কেল গুড়ুম, সন্তান আর বাবা দুজনেরই। আমও যাবে, ছালাও যাবে। সন্তানের সাথে সাথে অভিভাবকেরাও যেভাবে ফাঁস করা প্রশ্নের পেছনে ছুটছে, তাতে তাদের সন্তানের অবস্থাও হবে আমার কল্পিত সন্তানের মতো।

আসলে হচ্ছেটা কী? প্রশ্ন ফাঁস নিয়েই মনে অনেক প্রশ্ন জাগে: প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, নাকি পরীক্ষায় জালিয়াতি হচ্ছে, নাকি প্রশ্ন ফাঁস আর পরীক্ষায় জালিয়াতির সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় সংঘবদ্ধ সাবোটাজ হচ্ছে? সাবোটাজের কথা বললেই এটাকে অনেকে ‘পলিটিক্যাল বক্তব্য’ বলে ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ক আলোচনা আগেও ছিলো, কিন্তু ইদানীং খুব বেশি জোরেশোরে বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে। বিষয়টা তাই বেশি ভাবিয়ে তুলছে।

কিছুদিন আগে দেখেছি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ফেসবুকের ‘প্রশ্নহাট’-এ বিজ্ঞাপন দিয়ে বি্ক্রি হচ্ছে। এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত, তারা নাকি আবার শিক্ষক, কৌশলে প্রশ্ন হাতিয়ে নিয়ে বিক্রির জন্য ফেসবুকে অফার দিচ্ছে। গত কয়েক দিন যাবত্ তারা আর টাকা-পয়সা কিছুই নিচ্ছে না। এমনি এমনি প্রশ্ন সবার হাতে দিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করা শুরু করেছে। এতোদিন ছিল তাদের মূল্যের বিনিময়ে বেপরোয়া প্রশ্ন-বাণিজ্য, এখন চলছে মূল্য ছাড়া পুণ্য-বাণিজ্য। এতেই বোঝা যায়, ডালমে কুচ্ কালা হ্যায়। প্রশ্ন ফাঁস শুধু প্রশ্ন ফাঁসের জন্য না-ও হতে পারে। মতলব অন্য কোথাও। সে মতলবটা কী? জানা নেই, তবে আন্দাজ করা কঠিন কিছু নয়। অনুমিত মতলব, পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া এবং প্রমাণ করে দেখানো যে, কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যর্থ, পারেনি তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে। সুতরাং এদেরকে আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় রাখা যাবে না, ইনকিলাব জিন্দাবাদ। লাগাও আন্দোলন। শুরু করো জ্বালাও পোড়াও আগের মতো। ক্ষমতায় আনো ওদেরকে যারা নিজেরাই লেখাপড়া করেনি। তাহলেই হবে পোয়াবারো। প্রশ্ন ফাঁসের প্রশ্নই আর উঠবে না। মেধাবী তরুণদের লেখাপড়া করানোরই দরকার হবে না। তারা জাহাজে মহাআনন্দে ভ্রমণ করবে!

অতি সম্প্রতি প্রশ্ন ফাঁসের সাথে যুক্ত হয়েছে ভুলে ভরা প্রশ্নপত্র। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা লিখেছে: ‘চলমান প্রাথমিক সমাপনীর (পিইসি) ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি’ পরীক্ষায় এক প্রশ্নপত্রে অর্ধশতাধিক ভুল ধরা পড়েছে।’ সিলেট বোর্ডের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্রে ৫০টি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মধ্যে ৪০টিতেই ভাষা ও ব্যাকরণগত ভুল। বুঝলাম, প্রশ্নে যারা ভুল করে তারা অবশ্যই প্রশ্নপ্রণেতা শিক্ষক। ভুল করেন, কারণ হয়তো তারা নিজেরাই ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে কিংবা অসদুপায়ে পরীক্ষা দিয়ে তথাকথিত ভালো রেজাল্ট করে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষকতার চাকরিটি বাগিয়েছেন কিন্তু সর্বদাই শিক্ষাহীন। কিন্তু যারা প্রশ্ন ফাঁস করে তারা কারা? তারা কি শুধুই শিক্ষক, প্রশ্নপত্র কম্পোজ করা থেকে শুরু করে মুদ্রণ ও বিতরণ পর্যন্ত বেশ দীর্ঘ চেইনের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, নাকি অন্য কেউ? কোনো গভীর অনুসন্ধান কি হয়েছে? পারিপার্শ্বিক তথ্য-উপাত্ত কি বিশ্লেষণ করা হয়েছে? কারা এ দুর্বৃত্তায়নের কাজটি বার বার করে যাচ্ছে এবং কেন করছে, তা কি আন্তরিকতার সাথে খতিয়ে দেখা হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে দেশের উদ্বিগ্ন জনগণ জানতে পারছেন না কেন? আর যদি না হয়ে থাকে, কেন হচ্ছে না?

এভাবে আর বসে থাকা যাবে না। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই জোরেশোরে কাজে নেমে পড়তে হবে। তা এখনই। প্রথমেই দেশপ্রেমী নিবেদিত কয়েকজনকে দিয়ে একটি উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষাসংক্রান্ত কাজ শিক্ষাজগতের লোকদের দিয়েই করাতে হবে। তারা তাদের জগত্টা অন্যদের তুলনায় অবশ্যই বেশি ভালো বোঝেন। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় অনতিবিলম্বে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। দ্বিতীয়ত, এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীরা আনন্দঘন পরিবেশে পরীক্ষা দিবে। পরীক্ষা যে ভীতিজনক কিছু নয় তা শিক্ষার্থীদের নিকট স্পষ্ট করতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব, স্কুলেও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ পরীক্ষা শিক্ষার্থীবান্ধব হচ্ছে না। ভীতিকর পরিবেশে পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা অসদুপায় অবলম্বন করতে চাইবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এসব কীভাবে করা যাবে তা খতিয়ে দেখার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রের বোদ্ধাদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা যায়। তৃতীয়ত, অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারটা তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে আইটি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে এখন এ ধরনের বিশেষজ্ঞের অভাব আছে বলে আমার মনে হয় না। একই সাথে প্রশ্ন ফাঁস রোধের লক্ষ্যে পরিকল্পিত উপায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিভাবকদেরও বুঝতে হবে যে, নিজের সন্তানকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে উত্সাহ দিলে নিজের পায়ে কুড়াল মারা হবে। এতে শুধু দেশের ক্ষতিই হবে না, বিদ্যাহীন ‘শিক্ষিত’ সন্তানদের অকর্মণ্যতা পরিবারকেও ধ্বংসের মুখে টেনে নিয়ে যাবে। এরা সম্পদ হবে না, হবে একশ’ ভাগ দায়, পরিবার এবং দেশ উভয়ের জন্য।

একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। শুধু একটি কাজই যথেষ্ট। তা হলো, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়ে যিনি এ দেশকে শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন, সেই জাতির জনক যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাঁর সাধের বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষার নাভিশ্বাস অবস্থা দেখে সম্ভবত মরমে মরে যেতেন। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, বর্তমান সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক অভাবনীয় অর্জন রয়েছে। প্রায় সব স্কুল-বয়সী শিশুকে স্কুলগামী করা সম্ভব হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা অর্জিত হয়েছে, উচ্চ শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে, নারী শিক্ষায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বহুলাংশে বেড়েছে, বছরের প্রথম দিনে প্রায় ৩৬ কোটি পাঠ্যবই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দুরূহ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

এখন সময় এসেছে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার। ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে শিক্ষার মান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন ঢং-এর কোচিং বাণিজ্য আর প্রশ্ন ফাঁসের কালচার জিইয়ে রেখে মান উন্নয়নের কথা বলা বা চিন্তা করা হিপোক্র্যাসির সামিল। পলিসি প্রণেতা আর শিক্ষাব্যবস্থার হাল ধরে আছেন যারা তাদের সবাইকে বিনয়ের সাথে বলি, চোখ বন্ধ করে চলার সুযোগ নেই। বন্ধ-চোখে হাঁটলে হোঁচট খেতেই হবে। তখন শুধু আপনাদের পা-ই ভাঙবে না, দেশের পা-ও ভেঙে যাবে আপনাদের কারণে। অবশ হয়ে যাবে জাতির মেরুদণ্ড। সময় থাকতে ব্যবস্থা নিন। কী ব্যবস্থা নিতে হবে তা সঠিকভাবে উদ্ভাবন ও হূদয়ঙ্গম করার জন্য শিক্ষাজগতের নিবেদিত ও যোগ্য ব্যক্তিদের সাহায্য নিন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আশু ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান।

n লেখক :উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ