একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের জনসমষ্টির উপর। তবে জনসমষ্টিকে অবশ্যই সুশিক্ষায় স্বশিক্ষিত হতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী সংখ্যার একটি বড় অংশ এ পর্যন্ত শিক্ষা না নিয়েই ছিটকে পড়ে যাচ্ছে বাল্যবিবাহ নামক করাল গ্রাসে। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনও এর ভয়াবহতা থামেনি। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক (আইএফপিআরআই)-এর গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ছিল শতকরা ৬২ দশমিক ৩ ভাগ। আর ২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সালে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার শতকরা ৫ দশমিক ৪ ভাগ, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের বিয়ের হার ৩৭ দশমিক ৮ ভাগ। সবমিলিয়ে বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৪৩ দশমিক ২ ভাগ। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র এক হাজার টাকার দেনমোহরে বিয়ে হচ্ছে এইসব সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের যাদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। এবং দেখা গেছে কোনো দেনমোহর ধার্য হয়নি এমন বিয়েও অহরহ ঘটছে। মূলত বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একটি কন্যাশিশুর আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয় এবং শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ঘরে আটকে রেখে নারীর বনসাই অবস্থার সৃষ্টি করা হয়।
রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য পুরুষের ন্যায় নারীকেও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সচেতনতার অভাব, শিক্ষার অভাব, দরিদ্রতা, লিঙ্গীয় বৈষম্য, প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য কন্যাসন্তানের একটা বড় অংশ বাল্যবিবাহের কবলে পড়ে তারা একটি বৃত্তের ভেতর আটকে পড়ে। দরিদ্র পরিবারে মেয়েদের বোঝা হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে অভিভাবকরা মেয়েশিশুর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে এবং স্কুলজীবন পেরোনোর আগেই বিয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী কুফল ভোগ করতে হচ্ছে নারীদের। বাল্যবিবাহের মাধ্যমে নারীকে একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে না দিয়ে নারীর বনসাই সমরূপ অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।
নারীর হাজারো গুণের বিশালতাকে বাল্যবিবাহের মাধ্যমে চাপা দিয়ে নারীকে ভাবতে শেখানো হয় যে—‘তুমি নারী’। শেখানো হয় স্বামী-সংসারই নারীর একমাত্র সম্বল। এভাবে নারীর চিন্তার জগেক পরাধীন করে তোলা হয় যা এক ধরনের সাংস্কৃতিক উত্পাদন। এমন অবস্থায় যদি পরবর্তীকালে তাকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয় তখনো ঐ বাল্যবধূটির মন পড়ে থাকে গৃহকোণে। বাল্যবিবাহের মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থানটা পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে যায়। অনেক পরিবারের বাল্যবধূরা পরবর্তীকালে শিক্ষা গ্রহণের পর্যাপ্ত সমর্থন পরিবার থেকে পায় না। পরবর্তীকালে ঐসব নারীরা পরিবার, স্বামী ও সন্তানের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। সমাজের অন্যান্য উপাদান তথা অর্থনীতি, রাজনীতি ও উন্নয়ন সম্পর্কে তার জ্ঞান খুবই কম থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে থাকে না বললেই চলে। অতঃপর এরকম অপরিকল্পিত পরিবার সংসার জীবনে ডেকে আনে দাম্পত্য কলহ, নারীর ভগ্নস্বাস্থ্য, প্রসবকালীন মৃত্যু, শিশুর অকাল মৃত্যুসহ নানা রকম সমস্যা। বাল্যবিবাহের কারণে ভবিষ্যতে এসব নারী শারীরিক, মানসিক, সাংসারিক, যৌনজীবনে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পরবর্তী সময়ে জীবনমান উন্নয়নে এসব নারী কোনোরকম ভূমিকা রাখতে পারে না। বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে প্রতিফলিত। সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের জন্য যেসব ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার জন্য বাল্যবিবাহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। অথচ আমাদের দেশে নারীর কল্যাণ হিসেবে ‘শুভবিবাহ’কে সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সব বয়সের মানুষের মধ্যে সচেতনতাই পারে আমাদের মেয়েদেরকে বাল্যবিবাহের কবল থেকে রক্ষা করতে। এজন্য জনগণের মাঝে শিক্ষার গুরুত্ব ছড়িয়ে দিতে হবে। মানুষ শিক্ষিত হলেই বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানবে। মোটকথা, যখন অভিভাবকরা জানতে এবং বুঝতে পারবে যে বাল্যবিবাহ তার সন্তানের শরীর ও মনের জন্য ক্ষতিকর কেবল তখনই বাল্যবিবাহের মাত্রা শূন্যের কোটায় নামবে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের বছরে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে বাল্যবিবাহকে না বলার বিকল্প নেই। এজন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষকে বাল্যবিবাহের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়