‘আমার মোবাইল নম্বরে প্রতিদিন ১২ থেকে ২৫টি মেসেজ পাঠাচ্ছে গ্রামীণফোন। এর অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজের অফার। এত মেসেজের ভিড়ে কোন প্যাকেটটি ব্যবহার করব নিজেই বুঝতে পারি না। ৫০ টাকা দিয়ে একটি প্যাকেজ নেওয়ার পর- কেটে নিচ্ছে ৭০/৮০ টাকা। অথচ ঘোষণায় থাকছে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৫০ টাকা। আর এক জিবি কেনার পর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ওটা নেমে আসছে ৪০০ বা ৫০০ মেগাবাইটে। কিভাবে কাটা যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।’ ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। বেশ ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই তিনি বলেন, এসব নিয়ে অভিযোগ দেব কার কাছে? এখন তো আমাদের প্রয়োজনের তাগিদেই মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়।
এভাবে ইন্টারনেটের নানা অফারের ফাঁদে ফেলে প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে ১০-২০ টাকা করে কেটে নিচ্ছে গ্রামীণফোন। সাড়ে ৬ কোটি গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতি বছর গ্রামীণফোন লুটে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। আমিয় ঘোষ নামে শেওড়াপাড়ার এক মুদি দোকানি তো আরো ক্ষুব্ধ। তিনি গ্রামীণফোনের এই প্রক্রিয়াকে ‘বাটপাড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, ‘আমরা ইন্টারনেট নিয়ে এক ধরনের গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে গেছি। একটি ফাইল খুলতেই কেটে নিচ্ছে কয়েক মেগাবাইট। আবার বন্ধ করে রাখলেও ইন্টারনেট কমে যাচ্ছে! এই বিভিন্ন রকমের প্যাকেজ আর ইন্টারনেটের নামে টাকা কাটার চক্করে পড়ে আমাদের তো কাহিল অবস্থা।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহ্জাহান মাহমুদ গতকাল রবিবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘একাধিক প্যাকেজের নামে এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। আমরা এই প্যাকেজগুলো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছি। আজই একটি কমিটি গঠন করছি, এই কমিটি প্যাকেজের ধরন দেখে এবং কি ধরনের প্যাকেজ রাখা যায়- সে ব্যাপারে সুপারিশ করবে। তখন আমরা অপারেটরগুলোর অযৌক্তিক প্যাকেজ বাতিল করে দেব। পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট প্যাকেজের মধ্যে তাদের আমরা নিয়ে আসব।’
‘ইন্টারনেট এক গোলকধাঁধা। এর চক্করে পড়লে আর রক্ষা নেই। শুধু টাকাই যায়। কীভাবে কাটে তাও বুঝি না। আর সেবার নামে যা মেলে তা বলে লাভ নেই। ঢাকা শহরে তো মেইলটা খোলা যায়। কিন্তু বিভাগীয় শহরে বা জেলা শহরে একটা মেইল খুলতেই কয়েক মিনিট লাগে। এভাবে কি ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে?’ কিছুদিন আগে ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে ইন্টারনেট নিয়ে এভাবেই ক্ষোভের কথা বলেছিলেন তথ্য-প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। মন্ত্রী হওয়ার পর গতকাল আগের বক্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বর্তমান অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখনই আমি কিছু বলব না, ৭ দিন দেখি- এরপর বলব।’
গ্রামীণফোনের ক’টি ইন্টারনেট প্যাকেজ বর্তমানে চলছে? বিটিআরসির অনুমোদন আছে ক’টি প্যাকেজে? এর কোনো হিসাব গতকাল সারাদিন চেষ্টা করেও বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগ বের করতে পারেনি। সবশেষে একজন জুনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখি গ্রামীণফোনের কাছ থেকে হিসাবটা পাওয়া যায় কি-না?’ যারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে- খোদ তাদের কাছেই এর কোনো গোছালো হিসাব নেই। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে গ্রামীণফোন। ইচ্ছে মতো প্যাকেট তৈরি করছে, আর সেটা মেসেজের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পাঠাচ্ছে। বিটিআরসিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনের পর দিন এভাবেই চালাচ্ছে দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর।
বিদায় নেওয়ার কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছিলেন, গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি। বিষয়টি তাদের আমরা বলেছি। এদিকে ইন্টারনেটের প্যাকেজ নিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপনও কয়েকদিন আগে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘হাজার রকমের প্যাকেজের নামে জোচ্চুরি করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এত প্যাকেজ দেওয়া হয় শুধু মানুষকে বোকা বানাতে। সারাবিশ্বে এটাই স্বীকৃত। এখন গ্রামীণফোনের ৩০/৩৫ প্যাকেজ চলছে। ফলে এসব বিষয়ে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। আমরা এখন জিম্মি। তবে একটা কথা বলব, স্বল্প সময়ে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে এমন স্বপ্ন যেন দেখানো না হয়। সময় নেওয়া হোক- তাও এ ব্যাপারে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা হয়েছে। ডাক, ই-মেইল ও ফোন, ওয়েবসাইট এবং শর্ট কোডে অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে সর্বশেষ তাদের কাছে যে অভিযোগ এসেছে তার অধিকাংশই ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে মেগাবাইট কেটে নেওয়ার। ২০১৩ সালে নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে ২ হাজার ১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৪০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বরাদ্দের নিলামে গ্রামীণফোন নেয় ১০ মেগাহার্টজ।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন ছিল- গ্রামীণফোনের এত রকমের প্যাকেজ কেন? জবাবে তারা বলেছে, গ্রামীণফোনের ইন্টারনেট প্যাকেজ গ্রাহকদের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। প্রতিটি প্যাকেজই বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে প্রয়োজন ভেদে জনপ্রিয়। বিটিআরসি নির্দেশনা মতে ইন্টারনেট প্যাকেজের মেয়াদ ৩০ দিন থাকার কথা। জিপি কেন ৩০ দিন দিচ্ছে না? জবাবে তারা জানায়, তাদের সকল প্যাকেজ ও এর মেয়াদ বিটিআরসির অনুমোদন সাপেক্ষে বাজারে ছাড়া হয়। ইন্টারনেট ডেটা কোনো কারণ ছাড়াই ফুরিয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জিপি জানায়, এ বিষয়ে কারো নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি।