আবারো মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়াছে। এইবারের ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ রক্ষাকালী মন্দির। হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনাটি ঘটিয়াছে গত শনিবার রাত্রে। মন্দিরের সভাপতি ইত্তেফাককে জানাইয়াছেন যে, শনিবার রাত্রে তিনি মন্দিরে পূজাশেষে বাড়িতে চলিয়া যান। রবিবার সকালে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙা অবস্থায় মাটিতে পড়িয়া থাকিতে দেখেন। পরে পুলিশে খবর দেন। দুর্বৃত্তরা গভীর রাত্রে মন্দিরে প্রবেশ করিয়া এই অপকর্ম সংঘটিত করিয়াছে বলিয়া তিনি মনে করেন। রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলিয়াছেন যে বিষয়টি ‘সেনসেটিভ’। অভিযোগ পাওয়ার পর তিনি এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন। লক্ষণীয় যে, প্রায় একই ধরনের ঘটনা ইতিপূর্বে আরও ঘটিয়াছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তদের পরিচয় অজ্ঞাত থাকিয়া গেলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই যে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হইতেছে তাহা বুঝিতে কাহারো অসুবিধা হওয়ার কথা নহে। সেই উদ্দেশ্যের অবয়বটিও অনেকটাই স্পষ্ট। সেইটি হইল— প্রথমত, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা; দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা। সর্বোপরি প্রতিবেশী ভারতসহ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করিয়া রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের বিষয়টিকেও উড়াইয়া দেওয়া যায় না।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত হইলেও নানা অজুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিষয়টিও একেবারে আকস্মিক নহে। কক্সবাজারের রামু হইতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং সর্বশেষ ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনাপ্রবাহের ভয়াবহতাদৃষ্টে বলা অসঙ্গত হইবে না যে বিষয়টিকে হালকা করিয়া দেখিবার কোনো অবকাশ নাই। যে বা যাহারা ইহাতে ইন্ধন জোগাইতেছে তাহারা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সংগঠিত। হামলার ধরন বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় যে কখনো কথিত ধর্মীয় অবমাননার অজুহাতকে সামনে রাখিয়া সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হইতেছে, আবার কখনো-বা রাত্রির অন্ধকারে প্রতিমা ভাঙা বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিতেছে। স্বস্তির বিষয় হইল, উপর্যুপরি হামলা চালাইয়াও অশুভ শক্তি অদ্যাবধি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নস্যাত্ করিতে পারে নাই। তবে ইহাতে আত্মতুষ্টিরও সুযোগ নাই বলিলেই চলে। কারণ ধর্মীয় উপাসনালয় ও বাড়িঘরে হামলার কারণে তাহাদের মনে নিরাপত্তাহীনতার যে-ক্ষত তৈরি হইয়াছে তাহা সহজে মোচন হইবার নহে।
বলা সহজ যে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কাজটি মোটেও সহজ নহে। কারণ দেশের আনাচেকানাচে ছড়াইয়া থাকা মন্দিরসহ সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলির সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা বিধান করিবার মতো জনবল তাহাদের নাই। তবে সদিচ্ছা থাকিলে উপায় অবশ্যই আছে। সর্বোত্তম উপায়টি হইল, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা। বলিতে গেলে স্থানীয়ভাবে সবকিছুই তাহাদের নখদর্পণে। অতএব, তাহারা আন্তরিকভাবে সক্রিয় ও সচেষ্ট হইলে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত ও প্রতিহত করা তেমন কঠিন হইবার কথা নহে। তবে প্রশাসনের দায়িত্বই যে সর্বাধিক তাহা না বলিলেও চলে। বিশেষ করিয়া এই ধরনের নিপীড়ন ও সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রতিকারহীনতার যে গুরুতর অভিযোগটি রহিয়াছে তাহার অবসান হওয়াটা জরুরি। দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিচয় যাহাই হউক না কেন, তাহাদের ব্যাপারে অবশ্যই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করিতে হইবে।