• শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ অপরাহ্ন

আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্ক কে কার অলঙ্কার?

আপডেটঃ : শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই—এ রকম করে বলা হয়। অতিসম্প্রতি আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির দুই মাস ছয় দিনের মাথায় উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানকে আমেরিকা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি প্রদান করে। তখনকার দিনে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে সোভিয়েত বিরোধিতা প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল। দেশ বিভাগ পূর্বকালীন সময়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের রুশ প্রীতি এবং জহরলাল নেহেরুর সমাজতন্ত্র অনুরাগ নিশ্চয়ই মার্কিন নেতৃত্বের অজানা ছিল না। তাছাড়া পাকিস্তানের সোভিয়েত নিকটতর ভৌগোলিক অবস্থান হয়তো বাড়তি কারণ ছিল। মার্কিনিদের চেয়ে পাকিস্তান নেতৃত্বের আমেরিকামুখী পররাষ্ট্র নীতি ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠে ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতি কৌশলের কারণে। বিশাল ভারতের মোকাবিলায় পাকিস্তান তার অস্তিত্বের জন্য অস্থির ছিল। তাই দেখা যায় যে তত্কালীন দুটো মার্কিন সামরিক জোট-সেন্টো এবং সিয়েটো উভয়েরই সদস্য পদ গ্রহণ করে পাকিস্তান। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে এ সম্পর্কের স্থিতিবস্থা বজায় থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করে। বাংলাদেশের জনগণের উপর আরোপিত গণহত্যার চেয়ে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি তাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তান যখন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় তখন সাময়িকভাবে সম্পর্কের টানাপোড়েন ঘটে। শীঘ্রই পাকিস্তানকে অতি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় মার্কিনিদের। ২০০১ সালে যখন ৯/১১ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে খোদ আমেরিকার মাটিতে এবং প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে অবস্থান করছিলেন তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লুউ বুশ পাকিস্তানকে প্রধান মিত্র হতে বাধ্য করেন। প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মাত্র ৭২ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। পুরো আফগান যুদ্ধ পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হয়। ২০০২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ন্যাটোর বাইরে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে প্রধান মিত্রের স্বীকৃতি পায়। এ সময় পাকিস্তান ২৫ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা পায়। পাকিস্তান সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি লাভ করে। ওবামা প্রশাসন সামরিক সহায়তার বদলে অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দেয়।

 

২০০৮ সালে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা এনএ্সএ-এর পরিচালক ম্যাককনেল অভিযোগ করেন যে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা-আইএসআই প্রকারন্তে আফগান জিহাদিদের সহায়তা দিচ্ছে। ২০০৮ সালের ১১ জুন মার্কিন বিমান বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তে হামলা চালায়। এতে ১০ জন সীমান্তরক্ষী নিহত হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী একে আক্রমণ বলে অভিহিত করে। ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাইতে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দায়ী মনে করে। আফগানিস্তানে অবস্থিত মার্কিন বাহিনী অসংখ্যবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ড্রোন এটাক চালায়। মনে করা হয় পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত গোপন সামরিক চুক্তি বলে এসব আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে। তবে পাকিস্তানের নাগরিক সাধারণ একে তাদের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত বলেই মনে করে। ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর মার্কিন বিমান হামলায় ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এমনিতেই পাকিস্তানের জনগণ মার্কিন বিরোধী। আফগানিস্তানে অব্যাহত মার্কিন সামরিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রমে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এদিকে ভারত মার্কিন আফগান রাজনীতি ও সামরিক কলা-কৌশলে বর্ধমানহারে সহযোগী হয়ে উঠছে। আফগান রাজনীতির নানা ধরনের সমীকরণে পাকিস্তানের গৃহীত কার্যব্যবস্থা সব সময় মার্কিন অনুকূলে পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। ২০১১ সালকে বিবিসি আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্যোগের বছর বলে অভিহিত করেছে। এ বছর তিনটি ঘটনা- ১. ওসামা বিন লাদেন হত্যা, ২. র্যামন এ্যালেন ডেভিস ঘটনা, ৩. মালালা ঘটনা- সম্পর্ককে তিক্ততর করে তোলে। পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর অজান্তে ওসামা বিন লাদেনকে অ্যাবোটাবাদের অদূরে মার্কিন বাহিনী হত্যা করে। ডেভিস নামক মার্কিন ঠিকাদার দুই পাকিস্তানিকে গুলি করে হত্যা করে। স্কুল ছাত্রী মালালার প্রতি জঙ্গিদের আচরণে মার্কিনিরা ক্ষুব্ধ হয়। ২০১২-২০১৩-এর দিকে পাকিস্তান বিরোধী মার্কিন জনমত প্রবল হয়ে ওঠে।

 

এ বছরের প্রথম টুইটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার অভিযোগ করেন। এই অভিযোগে তিনি ইসলামাবাদকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া বন্ধের ঘোষণা দেন। ট্রাম্প ঐ টুইটে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বোকার মত ১৫ বছর ধরে পাকিস্তানকে ৩ হাজার ৩’শ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে। আফগানিস্তানে যে সন্ত্রাসীদের খোঁজ করে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান তাদেরই নিরাপদ আশ্রয় দেয়।’

 

পাকিস্তানের উপর আস্থা হারাবার পর নতুন মিত্রের সন্ধান করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গত আগস্টে প্রকাশিত মার্কিন কৌশলপত্রে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি আলোকপাত করা হয়। ২৩ জানুয়ারি কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নূর সুলতান নাজার বায়েফ হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। দৃশ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের অপর প্রতিবেশী কাজাখস্তানকে ব্যবহার করতে চাইছে। উল্লেখ্য যে, বর্তমান রুশ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বেশ অস্বস্তিতে আছে কাজাখস্তান। কাজাখ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলছেন, ‘যে দেশগুলো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে, তাদের ব্যাপারে কথা বলার মত নৈতিক অধিকার রয়েছে কাজাখস্তানের।’ একথা বলে মূলত তিনি ইরান ক্ষুব্ধ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খুশী করতে চেয়েছেন।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্প মনস্তাত্ত্বিকভাবে মুসলিম বিরোধী। তার মনোভঙ্গি পাকিস্তানের ব্যাপারেও কাজ করছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কিন্তু পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে তার আফগান রণকৌশল কার্যকর করাও বেশ কঠিন। তাই পাকিস্তানকে সকল সামরিক সহায়তা বন্ধ করলেও মার্কিন আমলারা নরম কথা বলছেন। তারা পাকিস্তানকে মার্কিন সহায়তা ফিরে পেতে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে পাকিস্তানকে তাগাদা দিচ্ছে। পাকিস্তানের মাটি তালেবান ও হাক্কানি গ্রুপের মত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো যাতে ব্যবহার না করতে পারে, সে ব্যাপারে দেশটির সরকারকে জোর দিতে বলা হয়েছে। পেন্টাগনের মুখপাত্র কর্নেল রব ম্যানিং সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা খুব সোজা-সাপ্টা। তালেবান ও হাক্কানি গ্রুপের নেতারা এবং হামলার পরিকল্পনাকারীরা পাকিস্তানের মাটি থেকে হামলা পরিচালনা ও দেশটিকে নিরাপদ ভূমি হিসেবে না ব্যবহার করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা।’ ম্যানিং আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিশেষ ও নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলেছে, যেটা তারা গ্রহণ করতে পারে। মতভেদ ছাড়াই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দমনে পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা কাজ করতে প্রস্তুত।’ উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সব ধরনের নিরাপত্তা সহায়তা বন্ধের সময়েই আভাস দেওয়া হয়েছে যে ব্যবস্থাটি স্থায়ী নয়। কেবলমাত্র সাময়িক ও সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে নির্দেশটি কার্যকর করা হবে। মার্কিন কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন যে ঐ সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তানের পাঠানো বেসামরিক সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

 

পাকিস্তানকে সকল সামরিক সহায়তা বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসলামাবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলে পাকিস্তান বলেছে, এটি স্বেচ্ছাচারমূলক ও একতরফা সিদ্ধান্ত। এদিকে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো সরকারের প্রতি প্রতিশোধ হিসেবে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। দু’দেশের কর্তাব্যক্তিদের বাদানুবাদে উত্তেজনা তীব্রতর হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও প্রতারণার’ অভিযোগ তোলেন, তার পরদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানস্থ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয় এবং পাকিস্তানের উদ্বেগ ও নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, শান্তি অর্জনে কাজ করতে হলে দরকার ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের পাশাপাশি পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন এবং আস্থা অর্জন। খামখেয়ালী সময়সীমা, একতরফা ঘোষণা ও লক্ষ্যস্থল পরিবর্তন অভিন্ন হুমকি মোকাবিলায় নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে ইসলামাবাদ বলেছে গত পনের বছরে প্রধানত নিজস্ব সম্পদ নিয়েই তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে এসেছে। তারা এসব কার্যক্রমে ১২ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে বলে দাবি করে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগ অস্বীকার করে আরো বলেছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ লড়াইয়ে তাদের অবদান এবং আত্মত্যাগ রয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের উপর নয়, বরং পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ ও নীতির উপর নির্ভর করে।

 

দেশে এবং বিদেশে আগ্রাসী নীতির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যেই সুনাম! অর্জন করেছেন। পাকিস্তানের ব্যাপারে ট্রাম্প যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা পৃথিবীর এই অঞ্চলে শান্তি, স্বস্তি এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার অভিযোগ করেছেন এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিই তাদের লক্ষ্য। তার মন্তব্যের সমর্থনে তিনি জর্জ ফ্রাইডম্যান লিখিত ‘দ্যা নেক্সট হানড্রেড ইয়ারস্’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেন। ঐ গ্রন্থে মন্তব্য করা হয় যে ‘রাশিয়া, চীন, ইরান ও অন্য আঞ্চলিক দেশগুলোকে নিরস্ত্র করতে দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।’ ট্রাম্পের উদ্দেশ যদি এমন হয় তাহলে পাকিস্তানসহ উপমহাদেশে শান্তি সুদূর পরাহত। শুধুমাত্র পাকিস্তানের স্বার্থে নয়, গোটা বিশ্বের স্বার্থে শান্তি একটি বহুলাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। জণগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভুত্ব চায় না। তারা শান্তির পিয়াসী। সুতরাং বিশ্ব শান্তির স্বার্থে আমেরিকা-পাকিস্তান তাদের সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস করুক- এটাই সকলের প্রত্যাশা।

 

n লেখক :অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ