একজন নারী উচ্চভোল্টের বৈদ্যুতিক টাওয়ারে উঠিয়া হাঁটাহাঁটি করিতেছেন। আর সেই লোমহর্ষক দৃশ্য দেখিতেছেন হাজার হাজার উত্সুক জনতা। তাহারা প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কের সহিত পার করিতেছেন—কখন না জানি ১৩৩ ফুট উঁচু টাওয়ার হইতে পা ফসকাইয়া কিংবা উচ্চভোল্টেজে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হইয়া মৃত্যু ঘটে ওই নারীর! ইহা কোনো সার্কাসের দৃশ্য নহে। ঘটনাটি ঘটিয়াছিল দুই বত্সর পূর্বে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ-মানিকনগর এলাকায়। অত্রাঞ্চলের ২ লক্ষ ৩০ হাজার (২৩০ কেভি) ভোল্টের সঞ্চালন লাইনের সিদ্ধিরগঞ্জে শিমরাইলের ৮ নং টাওয়ারে উঠিয়া পড়েন ওই নারী। ২০১০ সালেও ওই একই টাওয়ারে উঠিয়া পড়িয়াছিলেন আরেক নারী। ভাগ্য ভালো বলিতে হয় ওই দুই নারীর। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহায়তায় তাহারা বাঁচিয়া যান। কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল না চট্টগ্রামের খোরশেদুল আলম নামের ১৭ বছরের এক কিশোরের। গত বত্সর ২৯ এপ্রিল একটি ভবনের তিন তলার ছাদে উঠিয়া খোরশেদুল আলম মোবাইল ফোনে কথা বলিতে বলিতে ওই ছাদসংলগ্ন ৩৩ হাজার কেভির বৈদ্যুতিক তারের কাছাকাছি চলিয়া যায়। অতঃপর উচ্চভোল্টেজের বিদ্যুতের তীব্র আকর্ষণে ওই তারে জড়াইয়া ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান খোরশেদ। জানা যায়, ৩৩ হাজার ভোল্টের লাইনের নিচে অপরিকল্পিতভাবে মার্কেট নির্মাণের কারণেই ঘটে ওই দুর্ঘটনা।
সমপ্রতি একটি সহযোগী দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে চট্টগ্রামের সাগরিকা চৌরাস্তার বিপজ্জনক চিত্র। ওই মোড়ে রহিয়াছে এক লক্ষ ৩২ হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক টাওয়ার। ইহার গায়ে ‘বিপজ্জনক’ লেখা থাকিলেও অনেকেই তাহা থোড়াই কেয়ার করেন। নিয়মানুযায়ী উচ্চভোল্টেজের ১০০ গজের ভিতরে কোনো স্থাপনা থাকিবার কথা নহে। অথচ চট্টগ্রামের সাগরিকা চৌরাস্তা সংলগ্ন টাওয়ারকে খুঁটি বানাইয়া দোকান তুলিয়া ব্যবসা করিতেছেন এক লোহা ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসসূত্রে জানা যায়, গত বত্সর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হইয়া মৃত্যু হইয়াছে ৩৫ জনের। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসূত্রে জানা যায়, ষোলশহর রেলক্রসিং ও হালিশহরসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক টাওয়ারের নিচে অবৈধ স্থাপনা গড়িয়া বসবাস করিতেছে চার শতাধিক ছিন্নমূল মানুষ। বিপদ জানিয়াও টাওয়ার-সংলগ্ন বিপজ্জনক চৌহদ্দির মধ্যে যাহারা বসবাস করেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযান চালাইয়া উচ্ছেদ করা হইলেও কিছুদিন পর তাহারা যথাস্থানে ফিরিয়া আসেন। এই ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অস্তিত্বের সংকটের কারণে ছিন্নমূল মানুষেরা ঝুঁকির কথা জানিয়া উচ্ছেদের পর আবার বিপজ্জনক অঞ্চলে বসতি গড়িতেছেন।
দেশের বিপুল সংখ্যক বৈদ্যুতিক টাওয়ারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৈন্যচিত্র দেখা যায়। প্রতিটি বৈদ্যুতিক টাওয়ারের চারদিকে ‘এন্টি ক্লাইম্বিং ডিভাইস’ দিয়া নিরাপদ রাখার নিয়ম রহিয়াছে। কিন্তু ইহার ব্যত্যয়ই যেন নিয়ম হইয়া গিয়াছে অনেক ক্ষেত্রে। হাইভোল্টেজ বৈদ্যুতিক টাওয়ার-সংলগ্ন বিপজ্জনক অঞ্চল হইতে মানুষকে নিরাপদ রাখিতে যেই সকল নিয়মকানুন রহিয়াছে, তাহা কঠোরভাবে পালন করিতে হইবে। অন্যথায়, বিপদকে বিপদ হিসাবে একজনও যদি বুঝিতে অক্ষম হন, তাহার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এড়াইতে পারেন না। সুতরাং এইক্ষেত্রে নিয়ম পালনে কোনো প্রকার অবহেলা কাম্য নহে।