• রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:

মশা নিয়ে হেলাফেলা নয়

আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৮

‘মশা মারতে কামান দাগানো’—কথাটি বাংলাদেশে আজ আর ব্যঙ্গ করে বলা হয় না। সত্য-সত্যই আজ মশা নিধনে বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থান ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে অনেক প্রজাতির মশার বিচরণ। তাদের বংশ বিস্তারের জন্য যা যা দরকার তার সবকিছুই আছে বাংলাদেশে। আর ঢাকা শহর তো মশার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মশার কামড়ে ঘটছে মারাত্মক সব ব্যাধির বিস্তার। মশা দমন ও দংশন পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ। তবে মশা নিয়ে অনেক ভয়ভীতি থাকলেও এদের সম্বন্ধে আমাদের অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। আমরা যদি মশার জীবনচক্র, এদের রোগ ছড়ানোর পদ্ধতি এবং এদেরকে কিভাবে দমন করা যায় তা জানতে পারি তাহলে আশা করা যায় পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। জনস্বার্থে এই বিষয়গুলো সবাইকে জানানোর কম-বেশি দায়িত্বও রয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশনের।

 

বিশ্বে তিন হাজারেরও অধিক মশার প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে কিউলেক্স (Culex), এনোফেলেস (Anopheles) এবং এডিস (Aedes) প্রজাতির মশা সবচে মারাত্মক।  আমাদের দেশে এডিস প্রজাতির মশার ব্যাপকতা রয়েছে। হালে ঢাকা শহর তো এডিসের সবচে প্রিয় আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। এই প্রজাতির মশা ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, জিকা আর ইয়োলো ফিভার রোগ ছড়ায়। এগুলো ভাইরাস জাতীয় রোগ। মজার ব্যাপার হলো যেখানে মানুষের বসতি রয়েছে সেখানেই এই এডিস মশার বসবাস। এদের বসবাস আমাদের বসতবাড়িতে, অফিস-আদালতে, যানবাহনে, স্কুল-মাদ্রাসায়, আসবাবপত্রের নীচে। কোথায় নয়? এই মশাগুলো বেশিদূর উড়তে পারে না। সাধারণত ৫০ থেকে ২০০ মিটারের মধ্যেই খাদ্যের প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে এরা বিচরণ করে। অনেক সময় শরীরে এদের কামড়  অনুভূত হয় না। স্ত্রী মশা গড়ে দুই থেকে তিন সপ্তাহ বাঁচে কিন্তু পুরুষ মশা এর থেকে কম সময় বেঁচে থাকে। স্ত্রী এডিস মশারই প্রয়োজন হয় মানুষের রক্তের। মানুষের রক্ত থেকেই এরা ডিম উত্পাদনের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পেয়ে থাকে। তাই মানুষের রক্ত সেবন ছাড়া স্ত্রী মশা ডিম উত্পাদনে সক্ষম হয় না। মশা যখন একজন মানুষকে কামড় দেয়, শরীরের রক্ত চুষে নেয় তখন মশাটি তার শরীর থেকে লালা ও মানুষের রক্ত তরল রাখার জন্য এক জাতীয় পদার্থ নিঃসরণ করে যাতে সহজে মানুষের রক্ত তার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। মশাটি যদি কোনো রোগের জীবাণু বহন করে তাহলে তার শরীরের লালা ও উক্ত তরল রাখার পদার্থের মাধ্যমে এই রোগজীবাণু অন্য মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হয়। মানুষ থেকে মশা, আবার মশা থেকে মানুষ এভাবে চক্রাকারে মশা রোগজীবাণু ছড়িয়ে থাকে। একটি রোগাক্রান্ত মানুষের রক্তের সঙ্গে যে জীবাণু সে চুষে নেয় তা সে বহন করে বংশ পরম্পরায় আর রোগ ছড়াতে থাকে দিনের পর দিন।

 

মশা শুষ্ক স্থানে ডিম ছাড়লেও ডিম ফুটানোর জন্য পানির প্রয়োজন হয় যা অনেকটা বীজের অঙ্কুরোদগমের মতো। পানির সংসপর্শে না এলেও শীতের সময়ে ডিম বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত সতেজ থাকে। ডিম পাড়া থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে দেড় থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগে। একবার বাড়িতে মশার আনাগোনা হলে বংশ বিস্তারের জায়গা ধ্বংস না করা পর্যন্ত এদের থেকে নিস্তার পাওয়া অনেকটা অসম্ভব। সাধারণত বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে মশার ডিম থেকে বাচ্চা দেওয়া শুরু হয়।

 

মশার জীবন চক্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজন সঠিক মশক দমন কার্যক্রম। মশার উপদ্রব, মানুষের শারীরিক ক্ষতি ও আর্থিক খরচ বিবেচনা করে বলা যায়, মশা দমনে শুধু সিটি করপোরেশন আর সরকারের উপর নির্ভর করলে মশার হাত থেকে সমপূর্ণভাবে নিস্তার পাওয়া সম্ভব কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। যেহেতু এডিস জাতীয় মশার বসতি আমাদের বসতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তাই আমাদের বসতবাড়ি ও লোকালয়ের ভেতর থেকেই এদের দমন কার্যক্রম শুরু করা দরকার। বসতবাড়ির ও লোকালয়ের যেসব সম্ভাব্য জায়গায় স্ত্রী মশা ডিম পাড়তে পারে ও যেখানে পরে পানি জমে ডিম থেকে বাচ্চা জন্মাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলো শনাক্ত করে নিয়মিত পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ডিম নষ্ট করার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

মশার ডিম ও বাচ্চা উত্পাদনের জুতসই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে আমাদের চোখের সামনে পড়ে থাকা ভাঙা পাত্র, ফুলের টব, ছোট চৌবাচ্চা, খেলনা, ফেলে দেওয়া বোতল, টায়ার আর ফ্রিজের নীচে পানি জমার পাত্রটিও। মশা যাতে আমাদের বসতবাড়িতে এবং তার আশেপাশে সহজে জায়গা করে নিতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য মশা বিতাড়ক রাসায়নিক, বাড়িঘরের দরজা জানালায় প্রয়োজনীয় স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

মশা দমনে আমরা যেমন ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিতে পারি, তেমন সামাজিকভাবেও আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। আমরা যদি মাস কিংবা সপ্তাহের কোনো নির্দিষ্ট দিনকে মশা দমনের জন্য নির্ধারণ করি এবং পরিকল্পনামাফিক দমন কর্মযজ্ঞ চালাতে পারি তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, মশা দমনে আমরা অনেকটা সফল হবো। এর জন্য সিটি কাউন্সিলগুলোকে সঠিক উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মশার ভয়াবহতা ও দমন সম্বন্ধে সম্যক ধারণা দিয়ে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীকে সচেতন করতে হবে। মশা দমনে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ