*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল*
ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বচ্ছ্বন্দে জীবন যাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে জাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। ২য় হিজরীতে জাকাত ফরয করা হয়।
জাকাত শব্দের অর্থ শুচিতা ও পবিত্রতা, শুদ্ধি ও বৃদ্ধি। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে শরিয়ত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ কুরআনে বর্ণিত আট প্রকারের কোন এক প্রকার লোক অথবা প্রত্যেককে দান করে মালিক বানিয়ে দেয়াকে জাকাত বলে। ধনীর সম্পদের যে অংশ ধর্মীয় বাধ্যবাধকতায় সমাজে বণ্টন করতে হয়, সেটিই জাকাত। তা গরিব আতœীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশীর মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয় সাধারণত। অবশ্য জাকাত প্রদানের মূল উদ্দেশ ও আমাদের দেশে জাকাত প্রদানের পদ্ধতির মাঝে সঙ্গতি কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার বহুবিধ কারণ রয়েছে বৈকি! তারপরও জানতে ইচ্ছে করে, আমাদের দেশে কারা বা কতজন মানুষ জাকাত দেয়ার যোগ্য, কতজন মানুষ বা লাভজনক প্রতিষ্ঠান জাকাত দেন। আর তার পরিমাণইবা কত? কোন কোন অর্থনীতিবিদ জাকাতের পরিমাণ ও দাতা সংখ্যা হিসাব করতে সরকারের ‘আয়কর’ বিভাগের আয়করদাতাদের সংখ্যা ও আয়করের পরিমাণের উপর নির্ভর করতে চান।
আয়কর থেকে সরকার আয় করে। এর মাঝে ব্যক্তিগত আয়করও রয়েছে। ব্যক্তিগত আয়করের সাথে জাকাতের মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বেশ জটিল। কারণটা হচ্ছে, যারা কর দেন তারাও সরকারকে কর দেয়ার কথা উঠলেই মুখ ভারি করে বসে থাকেন। কেউ কেউ কর ফাঁকি দেয়ার ফন্দিফিকির আঁটতে থাকেন, আবার কেউ আয়কর উপদেষ্টাদের সাথে নিয়েও ফন্দি করেন আয়কর ফাঁকি দেয়ার। কিন্তু তারাই আবার সম্পূর্ণ হৃষ্টচিত্তে জাকাত দেন। জাকাতের বিষয়ে এরা সিরিয়াস। বরং জাকাত প্রদানে তারা আপসহীন; যেভাবে হোক জাকাতের অর্থ তারা পরিশোধ করবেনই।
আমি শুধুমাত্র আয়কর বা করদাতাদের হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকতে রাজি নই। কারণ তালিকাভূক্ত করদাতাদের বাইরে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী জাকাত দিয়ে থাকেন। তারপরও রয়েছে তালিকাভূক্তরাই কি সঠিক পরিমাণে আয়কর দেন?
পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে, জাকাত ওই সব লোকের ওপর ওয়াজিব যাদের কাছে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা তৎসমান অর্থ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক বছর যাবৎ রিজার্ভ বা জমা আছে।
পবিত্র কুরআন শরীফে জাকাতের অর্থ ব্যয়ের জন্য ৮টি খাত উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, ১) ফকির: ফকির যারা নিজেদের সাধারণ জীবন যাপন করতে পারে না। অনেক দু:খে-কষ্টে কালাতিপাত করে, তাদেরকে জাকাত দেয়া হবে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে জাকাত নেয়া হবে, আর গরিবের মাঝে বিতরণ করা হবে।’ ২) মিসকিন: সহায়-সম্বলহীন হতদরিদ্র ব্যক্তি যার কাছে নগদ অর্থ বলতে কিছুই নেই-এমন লোকদের জাকাত দেয়া হবে। ৩) কর্মকর্তা-কর্মচারী: জাকাতের পয়সা বা সম্পদ উসুল করার কাজে নিয়োজিত কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন ভাতার কাজে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা হবে। চাই এরা ধনী হোক অথবা গরিব। সর্বাবস্থায় এ জাকাতের থেকে তারা তাদের বেতন ভাতা গ্রহণ করতে পারবে। ৪) কৃতদাসকে মুক্তকরার জন্য: কৃতদাস বা কৃতদাসীকে মুক্ত করার জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। ৫) মুআল্লাফাতে কুলুব: অমুসলিম বা কাফের সম্প্রদায়ের জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। যাতে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। একমাত্র এ ধরনের কোন উদ্দেশ্য ছাড়া অমুসলিমদের মধ্যে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। ৬) ঋণগ্রস্ত: ঋণগ্রস্ত কোন ব্যক্তির ওপর তার ঋণের বোঝা কমানো বা ঋণ মুক্ত করার উদ্দেশে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। ৭) ফি সাবিলিল্লাহ খাত: ফি সাবিলিল্লাহ বলতে যারা আল্লাহর পথে বিভিন্নভাবে জিহাদরত তাদের সার্বিক সাহায্যার্থে জাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে। ৮) মুসাফিরদের জন্য: কোন মুসাফির ব্যক্তি পথিমধ্যে অর্থাভাবে বিপদগ্রস্থ বা অসহায় হয়ে পড়েছে। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছার মত কোন সম্বল তার সঙ্গে নেই। এমতাবস্থায় জাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা বা লোকটির জন্য জাকাতের অর্থ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ।
জানামতে, জাকাত এমনভাবে দেয়া উচিত যেন উপার্জন সৃষ্টিকারী কর্মকান্ডে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে অভীষ্ট ব্যক্তিদের দারিদ্র্যের দুর্দশা থেকে মুক্ত করা যায়। আমাদের দেশে গণহারে প্রদত্ত শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল, মশারি ইত্যাদি পণ্য প্রত্যক্ষভাবে গরিব মানুষের জীবনাচারে কাজে লাগলেও, আয়ের জোগান দিচ্ছেনা বলেই বিশ্বাস করি। জাকাত বণ্টনের কাঠামোগত পদ্ধতি ইসলামে বিধৃত থাকলেও তা আমরা মানছিনা বলা যায়। এর একটা স্থানীয়কৃত রীতি দাঁড়িয়ে গেছে দেশে। রোজার মোটামুটি ১০-১৫ দিনের মধ্যেই সামর্থবান ব্যক্তিরা জাকাতের কাপড়চোপড় হয় নিজে কেনেন নয়তো কাউকে দিয়ে ক্রয় করান এবং পরে সময়মতো সেগুলো বিলি করেন গরিব আতœীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে। ঢাকায় বসবাসরত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একটি অংশ গ্রামের বাড়িতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বারদের কাছে জাকাত দিয়ে দেন। তারা সেগুলো বণ্টন করেন। কেউ কেউ আবার মসজিদের ইমাম কিংবা মাদ্রসার মৌলভী বা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের তত্ত্বাবধানেও জাকাত বিতরণ করে থাকেন। আবার অনেকে মনে করেন, শাড়ি-কম্বল কেনার চেয়ে এতিমখানায় জাকাতের অর্থ দেয়াই ভাল। এতিমখানায় দেয়া জাকাতের সব অর্থই ভোক্তা চাহিদা বৃদ্ধিতে ব্যয় করা হয় এ কথা মেনে নিতে পারিপার্শ্বিকতায় মানতে সায় নেই। কোনো কোনো বিবেচক ব্যক্তি জাকাতের জন্য নিয়ত করে রাখা অর্থ দিয়ে গরিব আতœীয়স্বজন বা প্রতিবেশীকে রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মাছ ধরার জাল, নৌকা প্রভৃতি কিনে দেন। আবার জাকাতের অর্থ মসজিদসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদি নির্মাণ ও সংস্কারে দিতে পছন্দ করেন এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। দেশে অনেক কওমী মাদ্রাসা পাওয়া যাবে যেগুলোর ভিত্তি জাকাতের অর্থে রচিত হয়েছে। জাকাতের অর্থে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারও রয়েছে। এ অর্থে অনেকে গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের কথাও ভাবেন।
তবে খুবই পরিতাপের বিষয়, কোন কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাকাতের অর্থে কেনা কাপড়, লুঙ্গি, কম্বল ইত্যাদি বিতরণের ঘোষণা দেন এবং সেই পণ্যগুলো নিতে গিয়ে প্রতিবছরই দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অভিপ্রায়ে জাকাত দেয়ার মানসিকতা এবং সস্তা আত্মপ্রচারণা চালানোর প্রয়াসের কারণে এ ধরণের ন্যাক্কার জনক ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটছে। এসবই আমাদের বিচক্ষণতার অভাব ও উদাসীনতার ফল। জাকাত বণ্টনের নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ পদ্ধতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। নইলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বঞ্চিত জনগোষ্ঠী জাকাত তহবিলের বৃহৎ অংশীদার হতো; নির্বাচনী বছরে মনোনয়ন প্রত্যাশী একশ্রেণির ব্যক্তি অভাবী-অনাভাবী বাছবিচার না করে শুধু নিজের ভোট ব্যাংক ‘তৈরিতে’ হাত খুলে জাকাতের অর্থ ঢালতেন না।
দেশে জাকাত সুষ্ঠুভাবে বিতরণের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জাকাত বোর্ড বলে একটা পরিষদ রয়েছে। বর্তমানে এটি রয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তবে যথাযথভাবে জাকাত সংগ্রহ, তদারকি ও বিতরণের জন্য যে ধরনের কাঠামোগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার, সে সাধ ও সাধ্য কোনোটাই বোধকরি তাদের নেই। ব্যবধান রয়েছে জনগণ ও জাকাত বোর্ডের আস্থায়ও। অনেকেই মনে করেন, ঠিক শরিয়ত মেনে জাকাত ব্যবস্থাপনা করতে পারে না জাকাত বোর্ড। অথচ জাকাত তহবিলের প্রতি আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দৃষ্টি স্বভাবতই খানিকটা নরম। সৌদি আরব, কুয়েত ও বিশেষত মালয়েশিয়ায় চর্চিত মানসম্মত অনুশীলন; জাকাত পরিচালনা প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য কাঠামোয় আনতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তানের মতো কিছু দেশ কার্যকরভাবে জাকাত বণ্টনে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনজিওকে বেছে নিয়েছে। জাকাতকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করার সাফল্যও দেখিয়েছে কোনো কোনো দেশ। জাকাতের অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে।
তবে অনস্বীকার্য যে, দ্রুত জাকাতের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা দরকার। কেননা ব্যক্তি যে উদ্দেশে জাকাত দিচ্ছেন, অনেক সময়ই তা পূরণ হচ্ছে না পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে। একই কারণে জাকাতের অর্থে পর্যাপ্ত প্রবাহ ধরে রাখা যাচ্ছে না, প্রায়ই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না সেটি। বরং কিছু ক্ষেত্রে জাকাত আটকা পড়ছে ভুল ব্যক্তিদের হাতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক ব্যক্তির বড় ভাই পুলিশ বিভাগে বড় পদে চাকুরি করার পরও জাকাতের অর্থ পাচ্ছেন তিনি। দুই ভদ্রমহিলার আর্থিক অবস্থা একসময় খারাপ ছিল, এখন একজনের ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে; আরেকজনের ছেলে সৈনিক অথচ জাকাতের অর্থ নিচ্ছেন তারা। এসবই জাকাত প্রদানে আমাদের কাঠামোগত টেকসই পরিকল্পনার অভাবে ঘটছে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) শাসনামলে খুবই সুচারুভাবে জাকাত বণ্টন হতো। সুকৌশলী ওমর(রা.) যে কার্যকর বিতরণ ব্যবস্থা চালু করেন, তাতে উপার্জন সৃষ্টিকারি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গরিবরা উপকৃত হতেন। ফলে তার শাসনামলে প্রতি বছরই কমেছে সুবিধাপ্রত্যাশী তথা জাকাত গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা। আমাদের জাকাত ব্যবস্থাপনার ভিত্তিও ওই দর্শনের ওপর হওয়া উচিত। যেন এর মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটানো যায়।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।