• রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:

ঈদুল ফিতর ঃ সর্বজনীন জাতীয় উৎসব

আপডেটঃ : শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮

*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল*
ঈদ শব্দের অর্থ ফিরে আসা, আনন্দ, খুশি, উৎসব প্রভৃতি। যে খুশির দিনটি মানুষের মাঝে বার বার ফিরে আসে তাই ঈদ। এবারের ঈদুল ফিতর দেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মানবতার বিপর্যস্ত মুহুর্তে শান্তি ও কল্যাণের ¯্রােতে একাত্ম হবার আহ্বানে ফিরে এসেছে। ঈদুল ফিতর ডাক দেয় ঘুরে দাঁড়াবার, সত্য ও সুন্দরের পক্ষে গণজাগরণের বার্তা নিয়ে আবারও এসেছে ঈদুল ফিতর। পুরো একটি মাসের সংযম পালন, ইন্দ্রিয়বৃত্তি নিয়ন্ত্রণ, কলুষ, অন্যায়, মিথ্যা, অবিচার থেকে পরিশুদ্ধ হৃদয়বৃত্তির পথে প্রত্যাবর্তনের সাধনার পর এসেছে ঈদ।
আজকাল একশ্রেণির নামি মুসলমান বিশ্ব মানবতার পরিশুদ্ধ নিদর্শন মাহে ‘রমজান’ নিয়েও প্রতারণা করে থাকে। কখনো নিজের সাথে, প্রতিবেশি বা পরিচিতের সাথে কিংবা ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশ বা জাতির সাথেও। ওই শ্রেণির মুসলমানরা ‘রোজা’ রাখার নামে দিনভর ‘উপোষ’ করে। সুযোগ বুঝে পানাহার করে, সংযমের বদলে ইন্দ্রিয়বৃত্তির চর্চা করে, প্রতিবেশি বা পরিচিত জনের সামনে সিয়াম পালনের মনোভাব দেখিয়ে পাপার্জন করে এবং স্বীয় নগণ্য স্বার্থে দেশ তথা জাতির কথা ভুলে যায়। ইসলামের শান্তির বাণী তাদের কাছে তাচ্ছিল্যের-এরাই ‘মকরম’ বংশীয়।
দীর্ঘ এক মাস সংযম ও কঠোর সিয়াম সাধনার পর প্রতীক্ষিত ঈদুল ফিতর আমাদের মাঝে বার বার ফিরে আসে; সাম্য, মৈত্রী, মানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের পয়গাম নিয়ে আসে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে সর্বস্তরের মুসলমানরা মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। প্রাণে প্রাণে বয়ে যায় এদিনে খুশির জোয়ার। বছরের এই দিনটি কাটে খুবই উচ্ছ্বাসমুখরতায় ও জান্নাতি খুশির আমেজে-আবহে অগণিত মুসলিমকে ঘিরে। ঈদুল ফিতর শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়; সর্বজনীন সামাজিক উৎসবও বটে। ঈর্ষা, দ্বেষ, অনৈক্য-দূরত্ব ও বিভাজনের যে প্রবণতা- এই দিনে তা থাকবে না। মানুষে মানুষে মিলনের মধ্য দিয়ে দূর হবে অমানবিকতা ও বিদ্বেষ-বিভেদের পাতানো যতো নিষ্ঠুুরতার খেলা। বিগত দিনের পঙ্কিল জীবনচক্রে যে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব-দূরত্ব তৈরি হয় তা বেমালুম ভুলে গিয়ে সবাই একই কাতারে শামিল হয়। মুসলিম উম্মাহর অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠার দিন ‘ঈদুল ফিতর’ প্রীতির এক পুণ্যময় বন্ধনে গ্রোথিত করে সবাইকে। বিশ্ব মুসলিম সমাজের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয় ঈদের আনন্দাবেগ। বর্ণ, গোত্র ও ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে সকল মুসলিমই এ দিনটিতে উৎসবে শামিল হয়। ঈদ মুসলিম জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন এবং ইসলামি কৃষ্টি-সংস্কৃতির শুদ্ধতম বহিঃপ্রকাশ। তাই মানবতার কবি নজরুল গেয়ে ওঠেনÑ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ/ তোর সোনা দানা বালা খানা সব রাহে লিল্লাহ্/ দে যাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙ্গাইতে নিদ’। ঈদুল ফিতরের সারবত্তা ও ভেতরগত চেতনার কথা এই মহত্তম কবির চেয়ে বেশি করে কিছু বলার সাধ্য বোধ হয় ঊণবিংশ-বিংশ শতাব্দিতে আর কোন কবি-সাহিত্যিক বা অন্য কারো হয়নি। মানুষে মানুষে মেলাবার আহ্বান এবং ঘুমের ঘোরে অচেতন মুসলিম জাতির ঘুম ভাঙানোই যে ঈদুল ফিতরের ডাক- তাই নজরুল বলতে পেরেছেন তাঁর অসাধারণ মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ঈদ উদযাপনের ইতিহাস নতুন নয়। যুগে যুগে প্রত্যেক জাতিই নির্ধারিত দিনে তাদের ঈদ উৎসব পালন করতো। পবিত্র কুরআনেও বিভিন্ন জাতির ঈদ উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সম্প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই মিলে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে আনন্দ উৎসব করতো। একবার তারা এতে ইব্রাহীম (আ.)কেও আহ্বান জানালো। ‘অতঃপর তিনি তারকাজির প্রতি একবার তাকালেন এবং বললেন, আমি অসুস্থ। অতঃপর তারা তার প্রতি পিঠ ফিরিয়ে চলে গেলো।’ (সুরা আস্সাফ্ফাত-৮৮/৯০)। অনুরূপভাবে হযরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ও নির্ধারিত দিনে ঈদ উৎসব পালন করতো। মুসা (আ.) যখন তার রিসালাতের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের প্রাসাদে উপস্থিত হলেন তখন সে বল্লো, ‘হে মুসা! তুমি কি আমাদের কাছে এসেছো তোমার জাদু দ্বারা আমাদের দেশ থেকে বের করে দিতে? আমরাও অবশ্যই তোমার কাছে অনুরূপ জাদু উপস্থিত করবো। সুতরাং আমাদের ও তোমার মধ্যে এমন একটা স্থান ও সময় নির্ধারিত করো, যার ব্যতিক্রম আমরাও করবো না তুমিও করবে না’। মুসা (আ.) বললেন, ‘তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন এবং যেই দিন পূর্বাহ্নে জনগণকে সমবেত করা হবে।’ (সুরা ত্বোয়াহা-৫৭-৫৯)। হযরত ঈসা (আ.)-এর সময় তাঁর সম্প্রদায়ের উৎসবের দিনেই আকাশ থেকে খাদ্য ভরা খাঞ্চা নাজিল করা হয়েছিল। মহানবী হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন তিনি মদিনাবাসীদের দেখতে পান তারা ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামক দুটি উৎসব পালন করছে। এতে তারা নাচগান, খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন আনন্দানুষ্ঠান পালন করছে। মহানবী (সা.) এ অনুষ্ঠান দুটির তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় যে, তারা প্রাচীনকাল থেকেই এ দুটি উৎসব পালন করে আসছে। তখন নবী করিম (সা.) বললেন, আল্লাহ্তায়ালা তোমাদের দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়েও উত্তম দুটি দিন অর্থাৎ ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা দান করেছেন।
হিজরতের অব্যবহিত পর থেকেই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। উল্লিখিত ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ উৎসব দুটির রীতিনীতি, আচার ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলাম পরিপন্থী। শ্রেণি বৈষম্য, ধর্ম ও দরিদ্রের মধ্যে কৃত্তিম পার্থক্য, ঐশ্বর্য-অহমিকা ও অশালীনতার পূর্ণ প্রকাশে অযাচিতরূপে দীপ্ত ছিল এ দুটি উৎসব। কিন্তু ঈদুল ফিতর ঘোষিত হবার পর আগের সমস্ত অরুচিকর আচার অনুষ্ঠান বদলে গিয়ে ঈদ যথার্থভাবে কাঙ্খিত নির্মল আনন্দে রূপ নেয়। মূলত: মুসলমানরা ঈদুল আজহার চেয়ে ঈদুল ফিতরেই বেশি আনন্দ উৎসব করে থাকে। এই দিনটি নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, আশরাফ-আতরাফ সকলেই এক অনাবিল আনন্দের ¯্রােতে ভাসিয়ে দেয়। সকলেই এক মাঠে নামাজ পড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবার দ্বার থাকে অবারিত। ধনীরা সাদকাতুল ফিতর এর মাধ্যমে নিঃস্ব ও বঞ্চিতকেও তাদের আনন্দের ধারায় শামিল করে নেয়। আমাদের দেশে এই দিনটিতে সকলেই সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক ভূষিত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। সমাজের দরিদ্র শ্রেণিও এদিন থাকে আনন্দাপ্লুত। তাদের পেট সেদিন অভুক্ত থাকে না, তাদের পকেটও থাকে না অর্থশূন্য। ইসলামের অর্থনৈতিক সাম্যের বিধান এ দিনই মূর্ত হয়ে ওঠে। সকলেই নতুন পোশাক পরিধান, একই মাঠে জমায়েত, একই ইমামের পিছনে তাকবির ধ্বনির সাথে নামাজ আদায়, বুকে বুক মিশিয়ে কোলাকুলিÑএক নয়নাভিরাম স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা করে। একই দৃশ্য সর্বত্র। দীর্ঘ রোজার পর ঈদুল ফিতর পরিশুদ্ধ আত্মাকে সিরাতুল মুস্তাকিমে অবিচল রাখতে প্রেরণা জোগায় এবং দীর্ঘ তাকওয়ার প্রশিক্ষণকে বাস্তব রূপ দিতে শুরু করে।
ঈদে প্রত্যাশা থাকে একটাই- ঈদের আনন্দে এক কাতারে, এক আনন্দধারার সকলের সঙ্গে মিশে যাওয়া। আর এই আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে আয়োজনেরও কমতি নেই। সবগুলো টিভি চ্যানেলেই থাকে সপ্তাহব্যাপী ঈদের নানা অনুষ্ঠান। পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে থাকে নানা স্বাদের লেখা নিয়ে বড় কলেবরের ঈদসংখ্যা। ঈদ উৎসবের এসব অনুষঙ্গ সর্বজনীন। কেনাকাটা, বেড়াতে যাওয়া, অনুষ্ঠান অয়োজন-উপভোগ এগুলো কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আনন্দ আয়োজনে শরিক হন সবাই। তবে এই আনন্দে মগ্ন হয়ে যেন আমরা আমাদের দুস্থ স্বজন আর প্রতিবেশীদের কথা ভুলে না যাই। আমরা যদি আমাদের সঙ্গতি অনুযায়ী দরিদ্রদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারি, সকলকে নিয়ে আনন্দ-উৎসবে শরিক হতে পারি তাহলেই সার্থক হবে এ উৎসব। ঈদ উৎসবের আনন্দে যতো বেশি মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে, ততোই তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে ঈদের সর্বজনীনতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ঈদুল ফিতরের রীতির মধ্যে আছে ফিতরা বিতরণ-অর্থাৎ গরিব-দুঃখী সবার মধ্যে সম্পদ বন্টনের মধ্য দিয়ে এ আনন্দকে ছড়িয়ে দেয়া। উৎসব উদযাপনে সবাইকে সমভাগী করে নেয়া। ঈদের উৎসবটি তখনই মহিমান্বিত হয়ে উঠবে যখন অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো এতে শরিক হতে পারবে। এ লক্ষ্যেই ইসলামে জাকাত ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক যে, আমাদের দেশে সামর্থ্যবান অনেকেই রীতিমাফিক জাকাত দেন না। অন্যদিকে জাকাত দেয়ার জন্য আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনেরও প্রবণতা রয়েছে। প্রতি বছরই জানা যায়, জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে হতাহতের খবর। এসব খুবই দুঃখজনক।
বলা যায়, এবারে আমরা ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছি তুলনামূলক স্বস্তির পরিবেশে। রমজানের আগে থেকে বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলেও রমজানে পণ্যমূল্যে মাত্রাছাড়া অস্থিরতা দেখা দেয়নি। এছাড়া ঈদ যাত্রা নির্বিঘœ করতেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। যদিও পথের যানজট-ভোগান্তি থাকছেই। নির্বাচনী বছর হওয়ায় এবারের ঈদুল ফিতরের অনুষ্ঠানে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে, দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় কোন কোন নেতা অধিক দান-খয়রাত-অনুদান বিলাচ্ছেন। অন্য রাজনৈতিক দলের আস্ফালন না থাকলেও আন্দোলনের হুমকি দুর্ভাবনা তৈরি করছে। রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পরমতসহিষ্ণুতা ও সংযমের শিক্ষাও রমজান থেকে নেয়া যেতে পারে। কিভাবে একটি সুখী সমৃদ্ধ মানবতাবাদী দেশ গড়া যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। শুধু নিজেকে বা নিজের দল নিয়ে ব্যস্ততা নয়, চারপাশে চোখ মেলে তাকাতে হবে। অভাবী, দুঃখক্লিষ্ট নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানোই যে ঈদের আসল শিক্ষা তা আমাদের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। মেকি অশ্লীল ভোগসর্বস্ব আনন্দ উৎসবে মত্ত না হয়ে নিগৃহীতদের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ঈদ পালন করা প্রয়োজন। ঈদের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনের মাধ্যমে ধনী-গরিব সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হোক। বিভেদ বিদ্বেষ ভুলে গড়াগড়ি-কোলাকুলিতে কাটুক এইদিন। ঈদ মোবারক।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ