শেরপুর জেলার শ্রীবরদী পৌরশহরের শতবর্ষী কাচারি পুকুরটি এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। সেই ছবি ছাপা হইয়াছে রবিবারের ইত্তেফাকে। সেই সঙ্গে তুলিয়া ধরা হইয়াছে তিলে তিলে পুকুরহত্যার মর্মন্তুদ বিবরণও। পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য, হোটেল ও বাজারের ময়লা-আবর্জনা হইতে শুরু করিয়া যাবতীয় বর্জ্যই ফেলা হইতেছে পুকুরটিতে। যথারীতি সেই সঙ্গে চলিতেছে দখলের চিরাচরিত উত্সবও। পুকুরের বেশ কিছু জায়গা দখল হইয়া গিয়াছে ইতোমধ্যে। একদা যেই পুকুরটি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি পরম বন্ধুর মতো স্থানীয় জনগণের শত উপকারে আসিত, দখলে-দূষণে তাহাই এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকির কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। দুর্গন্ধে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে জনজীবন। অথচ দেখিবার কেহ নাই। কিছু লোকের সীমাহীন লোভ ও দায়িত্বহীনতার কুফল ভোগ করিতে হইতেছে সমগ্র জনপদের মানুষকে। আর ইহা যে কোনো বিচ্ছিন্ন চিত্র নহে—তাহাও বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বখ্যাত বাঙালিপণ্ডিত নীরদ সি. চৌধুরী বাঙালিকে ‘আত্মঘাতী’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি জাতি হিসাবে আমাদের নির্দয়তা যেন সেই কথাই মনে করাইয়া দেয়!
পুকুর-দিঘির জন্য একদা এই বাংলার বিপুল খ্যাতি ছিল। প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে তো বটেই, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও বড় বড় পুকুর-দিঘির অস্তিত্ব ছিল। বলিতে গেলে সবই ছিল মানুষের সৃষ্ট। তত্কালীন শাসকদের পাশাপাশি সামর্থ্যবান মানুষেরা এইসকল দিঘি খনন করাইয়াছিলেন জনস্বার্থে। জনসাধারণের জন্য মিঠা পানির নিরাপদ ভাণ্ডার গড়িয়া তোলাই ছিল তাহাদের মূল উদ্দেশ্য। ইহা অনস্বীকার্য যে, মোগল আমল কিংবা তাহারও আগে হইতে চলিয়া আসা এই কার্যক্রমের সুফল আমরা এখনো ভোগ করিতেছি। পরিতাপের বিষয় হইল, তুলনামূলকভাবে সীমিত সম্পদ, প্রযুক্তি ও জ্ঞান লইয়া শতবর্ষ আগে আমাদের পূর্বসূরিরা ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য যে মহত্ কর্তব্য সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন, অপরিমেয় সম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তির অসীম সম্ভাবনার যুগে বাস করিয়া এবং পৃথিবীর বিপন্নতার কথা জানিয়াও আমরা তাহার ঠিক উল্টো কাজ করিয়া চলিয়াছি।
অথচ কে না জানে যে, জনসংখ্যার চাপ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মিঠাপানির উত্স দিনদিন হ্রাস পাইতেছে। ইহার বিপরীতে বিস্তৃত হইতেছে লবণাক্ততার আগ্রাসন। আমরা বর্তমানে যে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর সর্বাধিক নির্ভরশীল সেই পানির স্তরই কেবল নিম্নগামী হইতেছে না, আর্সেনিকের মতো মারাত্মক দূষণ ছড়াইয়া পড়িতেছে সেইখানেও। এমতাবস্থায়, নিজে বাঁচিতে হইলে এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে বাঁচাইতে হইলে পুকুর-দিঘি-জলাশয়-হ্রদ-নদনদীসহ সকল মিঠাপানির উত্সকে সর্বাত্মকভাবে রক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। এই ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচ আছে। আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা। সর্বস্তরের প্রশাসন ও জনগণকে সেই আইন ও নির্দেশনাকে অক্ষরে অক্ষরে কাজে লাগাইতে হইবে। দখল ও দূষণকারী এবং তাহাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা যতই প্রভাবশালী হউক না কেন—প্রয়োজনে তাহাদের বিরুদ্ধে গড়িয়া তুলিতে হইবে কঠোর সামাজিক প্রতিরোধ। কারণ ইহার সহিত আমাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত।