দুদকের নামে ভুয়া চিঠি ইস্যু করে এক ব্যবসায়ীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালকের (মানিলন্ডারিং) পিএ গৌতম ভট্টাচার্যসহ একটি চক্র। অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার মতিঝিলের একটি হোটেল থেকে ঘুষের দেড় লাখ টাকাসহ তাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি বলছে, এ চক্রে আছেন দুদকের মহাপরিচালকের পিএ, পুলিশ সদস্য (বরখাস্ত) এসকেন আলী খান ও দুই দালাল হাবিবুর রহমান, পরিতোষ মণ্ডল।
শনিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এ ব্যাপারে ব্রিফিং করেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ।
তিনি জানান, ভুক্তভোগী আশিকুজ্জামান একজন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী। বায়তুল মোকাররম মসজিদের কার্পেটের দোকানে আমদানি করা কার্পেট ও জায়নামাজ সরবরাহ করেন। ১৯ জুন তার স্ত্রী সন্তান প্রসব করার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন।
২০ জুন সকালে আশিকুজ্জামানের উত্তরাসহ বাসায় দুদুকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের খামে একটি নোটিশ নিয়ে যান একজন অফিসার। তার (আশিকুজ্জামান) বিরুদ্ধে অভিযোগ, কার্পেট ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান এবং মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ তোলা হয়।
স্ত্রী হসপাতালে, এ অবস্থায় দুদকের এ অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে যান আশিকুজ্জামান। তখন দুদকের কথিত অফিসার আশিকুজ্জামানকে একটু সহানুভূতি দেখানোর ভান করে তাকে মোবাইল বন্ধ করে দিয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
হারুন বলেন, চক্রের সদস্যরা ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামানকে ডিবি, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক এবং এনএসআইয়ের ভয় দেখিয়ে বলে আপনার দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে সংস্থাগুলো হন্য হয়ে খুঁজছে। দুদক এরইমধ্যে দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি অভিযোগ আমলে নিয়েছে। এসময় নোটিশ বহনকারী ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে আশিকুজ্জামানকে কথা বলিয়ে দেন।’
‘হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের ওই কর্মকর্তা মোবাইলে কথা বলা সমীচীন নয় জানিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দুদক অফিসে স্বশরীরে হাজির হতে বলেন।’
দুদকের নোটিশে যা ছিল:
দুদকের নোটিশে বিভিন্ন অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে বলা হয়, তিনি শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাকে দুদকের জিম্মায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমতাবস্থায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। কারণ দর্শানোসহ ব্যক্তিগত শুনানির জন্য ১০ জুলাই নির্ধারণ করা হয়।
ডিবিপ্রধান বলেন, ঘাবড়ে যাওয়া আশিকুজ্জামানকে দফায় দফায় ফোন দেয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপে। ভয় দেখানো হয় সম্পত্তি ক্রোক করা, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করা, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে খবর প্রস্তুতি করাসহ সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনএসআই, ডিবি পুলিশ এবং দুদকের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করিয়ে কঠোর শাস্তির ভয় দেখানো হয়।
একটা পর্যায়ে আশিকুজ্জামানকে মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেলের দ্বিতীয় তলায় এসে সমঝোতার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। সমঝোতা অনুসারে প্রথমে দুই কোটি টাকা দিতে বলা হলেও পরবর্তীতে দিতে বলা হয় এক কোটি টাকা। বিনিময়ে সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এক কোটি টাকার ভেতর ২৩ জুন জুম্মার আগে ২০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। বাকি টাকা আগামী রবিবার ব্যাংক আওয়ারে পরিশোধের সমঝোতা হয়।’
ডিবির অভিযান:
হারুন অর রশীদ বলেন, ভিকটিম বিষয়টি গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগকে অবহিত করলে গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং দুদকের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলামসহ হোটেল হিরাঝিলের আশেপাশে অবস্থান নেয়।
সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চারটি মিষ্টির প্যাকেটে দেড় লাখ টাকা ভরে হোটেলে যান। বাকি টাকা ব্যাংকে দেবেন বলে জানান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা গ্রহণ করার সময় ডিবি পুলিশ তাদেরকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। ডিবি লালবাগ বিভাগের এডিসি রাকিবের নেতৃত্বে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- দুককের মহাপরিচালকের এপিএস গৌতম ভট্টাচার্য, হাবিবুর রহমান, পরিতোষ মন্ডল ও বরখাস্ত পুলিশ সদস্য এসকেন আলী খান।
তাদের কাছ থেকে মিষ্টির চারটি প্যাকেট, নগদ দেড় লাখ টাকা, চারটি মোবাইল ফোন, দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের একটি খাম ও দুদকের একটি নোটিশ উদ্ধার করা হয়।
ডিবি বলছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে গৌতম ভট্টাচার্য দুদকের ডিজি মানি লন্ডারিংয়ের পিএ হিসেবে কর্মরত। তার বাড়ি মৌলভীবাজার। এসকেন আলী খান চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। অপর দুইজন পেশাগতভাবে দালাল ও প্রতারক।
দুদক কর্মকর্তা গৌতম ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে দুদকের বিভিন্ন মহাপরিচালকদের পিএ হিসেবে কাজ করেছেন। কখনো দুদকের ডিজি (তদন্ত), ডিজি (অ্যাডমিন), ডিজি (প্রসিকিউশন), ডিজি (মানি লন্ডারিং) এর অফিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (পিএ) হিসেবে কাজ করেছেন।
গৌতম ভট্টাচার্য দুদকে কাজের কারণে দুর্নীতি সংক্রান্তে নোটিশ কীভাবে পাঠাতে হয়, কীভাবে তাদের কাছ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক ব্যাখ্যা নেয়া হয় এবং কীভাবে অভিযোগ গঠন করা হয় এসব বিষয় জানতেন। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তার দুষ্কর্মের সহযোগীদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং চাকুরীজীবীকে টার্গেট করে তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করে দুদকের চিঠির খাম ও প্যাড/ ফরমেট ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিশ পাঠাতেন।
পরবর্তীতে কখনো মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে, কখনো শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে বসে, কখনো আশেপাশের বিভিন্ন হোটেলে টার্গেটের টাকায় যেতে যেতে তাদেরকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি দিতে সমঝোতার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
এদের সঙ্গে দুদুক কার্যালয়ের দায়িত্বশীল আরও কেউ জড়িত আছে কি না খতিয়ে দেখার জন্য আসামিদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে।