রোহিঙ্গা প্রশ্নে আজ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বিতর্কে অংশ নিচ্ছে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো। ইতিপূর্বে নিরাপত্তা পরিষদের আহ্বান আমলে না নিয়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত রাখায় স্বভাবতই বিভিন্ন দেশ ক্ষুব্ধ। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের ওপর কঠিন চাপ প্রয়োগ করলে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তাকে সাধুবাদ জানাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। উন্মুক্ত বিতর্কের মধ্য দিয়ে গৃহীত প্রস্তাব পালন করা মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক। কাজেই নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো এমন হওয়া উচিত যাতে মিয়ানমার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্ব প্রদান ও অবাধ চলাচলের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য অধিকার প্রদান করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার জন্য যেহেতু মিয়ানমার দায়ী, সেহেতু এ সমস্যার সমাধানও করতে হবে তাদেরই।
আশার কথা, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চীন, রাশিয়া ও ভারত আগের চেয়ে অনেকটা নমনীয় হয়েছে। আমাদের এখন এমন কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন, যাতে দেশ তিনটি রোহিঙ্গা সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে অগ্রসর হয়। অবশ্য বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সব ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইতিমধ্যে ঢাকায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি অবহিত করা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশ সফরে এসে গতকাল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাপানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইওয়াও হরি। সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার জানিয়েছে জাপান। এছাড়া বাংলাদেশে এসেছেন তুরস্কের উপ-প্রধানমন্ত্রী। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমার সরকারের কাউন্সেলর অং সান সু চির প্রতনিধি দলের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
উন্মুক্ত বিতর্কে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশেরই অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গা সংকটের ভয়াবহতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা, যাতে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও অধিকারের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, এক মাস পেরিয়ে গেলেও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ হচ্ছে না। মাঝখানে কয়েক দিন রোহিঙ্গা জনস্রোত কম থাকলেও পুনরায় এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব ও ছিটুয়ে অঞ্চলে তল্লাশির নামে নতুন করে রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরু হওয়ায় ওইসব অঞ্চলের রোহিঙ্গারাও এখন বাংলাদেশের উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এ থেকে রাখাইন রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির একটি উদ্বেগজনক চিত্রই পাওয়া যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক চাপ এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী একে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা তাদের রোহিঙ্গা উচ্ছেদের মিশন তথা ‘জাতিগত নিধন’ অব্যাহত রেখেছে, যা কোনো সভ্য দেশের দৃষ্টান্ত হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনক যে, এরপরও এ তৎপরতা রোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মৌখিক চাপ প্রয়োগ ছাড়া দেশটির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা সংকট যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে একে এখন আর কোনো বিশ্বশক্তির পক্ষেই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাণিজ্য ও কৌশলগত স্বার্থের চেয়ে এক্ষেত্রে নৈতিক, মানবিক ও আন্তর্জাতিক আইনগত বিষয়গুলোই প্রাধান্য পাওয়া উচিত।