ইসরায়েলের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। দেশটি সংক্ষিপ্ত সময়ের ইতিহাসে ফিলিস্তিনি জনগণ এবং প্রতিবেশী আরব দেশ– উভয়ের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালায়। এমনকি ইসরায়েল সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রাসায়নিকও ব্যবহার করছে। যেমন, সম্প্রতি গাজা ও লেবাননে সাদা ফসফরাস বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে দখলদার রাষ্ট্রটি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পশ্চিমা সমর্থন পাচ্ছে। বিশেষ করে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে শর্তহীন পক্ষপাত। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রই নিজেদের বিশ্ব মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন বলে গর্ব করে।
তবে পশ্চিমা দেশগুলোই শুধু ইসরায়েলি বাহিনীকে সহায়তা করছে না। গভীর বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ইসরায়েলের অস্ত্রশিল্পে অর্থায়নের উল্লেখযোগ্য অংশ আসছে আরব বিশ্ব থেকে। সম্প্রতি সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বিষয়ে আলোচনা হয়, যদিও গাজা হামলার কারণে এ আলোচনা স্থগিত করে সৌদি আরব।
ইসরায়েলে প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারা? স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ ও ২০২২ সালের মধ্যে ইসরায়েলের ৯৯ শতাংশ অস্ত্রই আমদানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি থেকে। এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েল ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র আমদানি করে, যার ৭৯ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর ২০ শতাংশ জার্মানি থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলকে ২৪৬ বিলিয়ন ডলার সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ সালে বারাক ওবামা দেশটিকে ১০ (২০১৯-২০২৮) বছরে ৩৮ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি যুদ্ধ মেশিন এবং তার বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক প্রকল্পের প্রতি সমর্থন দৃঢ় ও দ্বিগুণ করছে, অন্যদিকে গত সাত দশকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে।
এদিকে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ২০২২ সালে ২৪ শতাংশ তথা প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করেছে, বিশেষ করে তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী আরব দেশগুলোতে। এর আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২১ সালে ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানির ৭ দশমিক ৫ শতাংশ যায় মাত্র দুটি দেশে– বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ভৌগোলিকভাবে, আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আরব দেশগুলো ইসরায়েলি অস্ত্রের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক হিসেবে আবির্ভূত। ইসরায়েল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৩০ শতাংশ অস্ত্র রপ্তানি করে এবং ইউরোপে রপ্তানি করে ২৯ শতাংশ। তার মানে, আরব দেশগুলো ইসরায়েলের অস্ত্রশিল্প এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে আছে। আরব দেশগুলো যখন ইসরায়েলের জন্য এই অবদান রাখছে, তখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ফিলিস্তিনের গাজায় মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ৪ সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু।
আরবদের এ অবস্থার বিপরীতে রয়েছে ইরান। ইরানের ফিলিস্তিন ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আল হিন্দি যেমনটা বলছেন, ‘শুধু ইরান (পশ্চিম এশিয়ার) একমাত্র দেশ, যে সব পর্যায়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে সমর্থন দেয়। এই দৃঢ় সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাম্প্রতিক সময়ে কৌশলগত বিজয় অর্জন করেছে।
৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের এক মাইলফলক অর্জিত হয়। মিসর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন আরব সেনারা ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের ওপর বড় আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। তার ৫০ বছর পর স্মৃতিতে খোদাই করা আরেকটি তারিখ হয়ে উঠবে ৭ অক্টোবর। এটা শুধু ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’-এ ফিলিস্তিনিদের সাহসী প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্যই নয়, বরং পশ্চিমা আধিপত্যের ওপর এক প্রচণ্ড আঘাত। এই হামলার মাধ্যমে ‘শক্তিশালী ইসরায়েল’-এর এক সময়ের আপাত দুর্ভেদ্য ভাবমূর্তি ভেঙে যায়। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ যুদ্ধের পর এমনটি আর দেখা যায়নি। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার অর্থায়নপুষ্ট এবং সশস্ত্র শক্তিশালী ইসরায়েলের মুখোশ ১৭ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো উন্মোচিত হয়। সে জন্য দুর্বল ইসরায়েল, যে সামরিক সাহায্যের আহ্বান জানাতে বাধ্য হচ্ছে, এখন পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের জন্য একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজায় গণহত্যা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আরব বিশ্বের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছে। একই সঙ্গে আরব দেশগুলোতে ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানিও বন্ধ। কারণ ইসরায়েলের নিজেরই এসব অস্ত্র দরকার। যারা চাইছে, এই যুদ্ধে আঞ্চলিক শক্তিগুলো যোগ দিক, তারা চায় শুধু ইসরায়েলের পরাজয় নয়; বরং দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে আরব বিশ্বের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথও বন্ধ হোক। একইভাবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে অর্থায়নের জন্যও আরব দেশগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।