রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপের ধারাবাহিকতায় গত রোববার অংশ নিয়েছে বিএনপি। দেশের দুই শীর্ষ দলের অন্যতম এই দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এই সংলাপে অংশ গ্রহণ করে। সংলাপে দলের পক্ষ থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ‘সহায়ক সরকার’ গঠন, নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন, ২০০৮ সালের আগের নির্বাচনী আসনের সীমানা পুর্নবহাল, ইভিএম-ডিভিএম পদ্ধতি চালু না করা, ১/১১ থেকে শুরু করে বর্তমান সরকারের সময় দলের চেয়ারপার্সনসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার, সব দলের জন্য সমান সুযোগসহ ২০ দফা প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী এই সংলাপের পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগামী নির্বাচন এবং রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কিছুটা আশাবাদী বলে জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের খুব বেশি কিছু করার নেই। বর্তমান সরকারের যে অগণতান্ত্রিক আচরণ যেখানে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না। তারপরও সংলাপের পর আমরা কিছুটা আশাবাদী তো বটেই। ‘তিনি আরো বলেছেন, বিএনপি বিশ্বাস করতে চায়, ইসির এই সংলাপ বা রোডম্যাপ নিছক কালক্ষেপণ বা লোক দেখানো কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এ সংলাপ যেন প্রহসনে পরিণত না হয় সেটা নির্বাচন কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য ইসি ‘সময় সময় গঠনমূলক সুপারিশ ও পরামর্শ’ দিতে পারে। সংলাপে ইসির পক্ষ থেকে তার সীমাবদ্ধতার কথা জানানো হয়েছে। এ সম্পর্কে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সংলাপে আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনও তাদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছে। তবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ আয়োজন ও সহায়ক সরকারের যে দাবির কথা তাদের বলেছি, সেই ব্যাপারে কমিশন তাদের ক্ষমতার মধ্য থেকে কিছু করার চেষ্টা করবে বলে আমাদের জানিয়েছেন।’
সংলাপে বিএনপির অংশগ্রহণকে পর্যবেক্ষক মহল ইতিবাচক বলেই মনে করছে। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার অভিমত, প্রস্তাব ও সুপারিশ থাকতেই পারে এবং তা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসির জানা প্রয়োজন, যার জন্যই মূলত ইসি এই সংলাপের আয়োজন করেছে। এটা দেশের মানুষেরও জানা আবশ্যক। বিএনপি দায়িত্বশীলতার এই দিকটি বিবেচনায় নিয়েই সংলাপে অংশগ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি যে আগ্রহী ও উদগ্রীব সেটারও প্রমাণ রেখেছে। গণতান্ত্রিক দল হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেয়া ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। বিএনপির পেশকৃত প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে ইসি কতদূর কি করতে পারবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলার উপায় নেই। ইসি’র সীমাবদ্ধতার কথা আমরাও জানি; তবে সদিচ্ছা থাকলে এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ইতিবাচক অনেক কিছু করা সম্ভব। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা ইসির দায়িত্ব এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা করা তার জন্য অবশ্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের মানুষ ২০১৪ সালে নির্বাচন নামের এক প্রহসন অবলোকন করেছে। দেশে-বিদেশে ওই নির্বাচন সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই পটভূমিতে বর্তমান ইসিকে এমন একটি নির্বাচন উপহার দিতে হবে যা হবে প্রশ্ন ও বির্তকের ঊর্ধ্বে। একরকম একটি নির্বাচন করতে হলে ইসিকে সর্ব প্রথম নির্বাচনের স্টেক হোল্ডারদের, বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই আস্থা স্থাপন করে যে, ইসির পক্ষে যথার্থ অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব, তাহলে তারা স্বত:স্ফূতভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে এগিয়ে আসবে এবং সেটা হলে ইসির গুরুত্বপূর্ণ একটি সাফল্য অর্জিত হবে। নির্বাচনের যথোপযুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে সকলের জন্য সমান সুযোগ ইসিকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যাশিত নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে যা কিছু করা প্রয়োজন, ইসিকে তা করতে আন্তরিক হতে হবে। বিধিমতে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সহযোগিতা করতে সরকার বাধ্য। এটা ইসির জন্য একটা বড় সুবিধা বা সুযোগ। অর্পিত দায়িত্ব পালনে কোথাও যদি কোনো সংকট, সমস্যা, আশঙ্কা ইসি অনুভব করে তবে সরকারকে তা বলতে পারে, এমনকি চাপ সৃষ্টিও করতে পারে।
বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মতে, কিছু বিষয় এমন আছে যেগুলোর ব্যাপারে কিছু করার এখতিয়ার ইসির নেই। এই বিষয়গুলোর ফয়সালা রাজনৈতিক পর্যায় থেকে আসতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ, ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত। নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকবে কি থাকবে না, ওই সময় কী ধরনের সরকার থাকবে এবং তার প্রকৃতি কেমন হবে, নির্বাচনের আগে-পরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে কি হবে না, তার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকবে কি থাকবে না, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার কি হবে-এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের অবশ্যকতা প্রশ্নতীত। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যার প্রধান শর্ত গ্রহণযোগ্যতা, নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হতেই হবে। আশার কথা, সরকার বা সরকারী দলের এ ধরনের সংলাপের প্রশ্নে এতদিন অনীহা থাকলেও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আগামীতে যে নির্বাচন হবে, তা যেন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, আলোচনা করে তার একটা পথ বের করব। আমরা চাই মানুষ মৌলিক অধিকার ও সংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে। যার যার প্রতিনিধি সে বেছে নেবে। স্মরণ করা যেতে পারে, ইতোপূর্বে তিনি একাাধিকবার বলেছেন, ৫ জানুয়ারি-মার্কা নির্বাচন আর হবে না। কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন তিনি দেখতে চান না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির সংলাপে অংশ নিতে আর বাকী আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। অচিরেই সে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। জানা গেছে, দলটির তরফে ১১ দফা প্রস্তাব দেয়া হবে। সংলাপ অনুষ্ঠিত হলে প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে জানা হবে। অনেকেই মনে করেন এবং কদিন আগে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তরা স্পষ্ট করেই বলেছেন, কাঙ্খিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী সেই সদিচ্ছা প্রদর্শনে কার্পণ্যের পরিচয় দেবেন না।