রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা ‘আরসেপ’
চীনের উদ্যোগে গঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ব্লক ‘আরসেপ’ (রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড ইকোনমিক পার্টনারশিপ)-এ বাংলাদেশ অচিরেই যোগ দিতে পারে, এই খবরে ভারতে বেশ অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এমনকি ঢাকার এই সম্ভাব্য পদক্ষেপের প্রভাব কী হতে পারে, সেটা ভালো করে যাচাই না করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টে’র (অবাধ বাণিজ্য চুক্তি) আলোচনা নিয়েও দিল্লি কিছুটা ‘ধীরে চলো’ মনোভাব নিতে চাইছে।
গত দুই-তিন দিনের মধ্যে ভারতের দুটি প্রধান অর্থনীতি-বিষয়ক দৈনিক ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ ও ‘দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন’ উভয়েই এ খবরের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
বিজনেস লাইন ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, ১৫ সদস্যের বাণিজ্য জোট আরসেপে যোগ দিলে বাংলাদেশে চীন থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণ অনেক বাড়বে বলে ভারতের ধারণা। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী হিসেবে ভারতেও এর একটা বড় প্রভাব পড়বে বলে দিল্লি মনে করছে।
সেই ‘প্রভাবটা’ কত বড় আর কী ধরনের হতে পারে, তা ভালোভাবে যাচাই না করে ভারত-বাংলাদেশ অবাধ বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাকে তড়িঘড়ি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না বলেই ভারতের মূল্যায়ন– বলছে বিজনেস লাইন।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড আবার বলছে, বাংলাদেশ আরসেপে যোগ দিলে সে দেশে ভারতের যে বিদ্যমান বাজার আছে, তার একটা অংশ ভারত হারাতে পারে বলে দিল্লিতে সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন। পাশাপাশি আরসেপভুক্ত কয়েকটি দেশে বাজার দখলের জন্য ভারতের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হবে বাংলাদেশের সঙ্গে।
এই জায়গাগুলোয় ঠিক কী কী হতে পারে, সেটা আগে শনাক্ত করে তারপরই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের কথা ভাববে বলে ওই পত্রিকাটি জানাচ্ছে।
‘আরসেপ’-এ ঢাকার যোগদানের সম্ভাবনা নিয়ে ভারত যে চিন্তিত তা উঠে এসেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে
সোজা কথায়, বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর পরই তারা আরসেপে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে– এই খবর দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করেছে। এমনকি দুই দেশের মধ্যে এই মুহূর্তে যে বাণিজ্য আলোচনাগুলো চলছে তার ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রসঙ্গত, আরসেপে যোগ দেওয়ার সুপারিশ করে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে যে ‘নোট’ পাঠিয়েছে, সে কথা সুবিদিত। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও বলেছেন, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানুয়ারি মাসের সংসদীয় নির্বাচনের পর।
আরসেপকে বিশ্বের বৃহত্তম ‘এফটিএ’ বা অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়– যাতে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘আসিয়ান’ভুক্ত দশটি দেশ, আর তাদের পাঁচটি এফটিএ সহযোগী– নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
২০১১ সালে যখন থেকে আরসেপ-এর খসড়া নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল, ভারতও তার অন্যতম সদস্য ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের নভেম্বরে নরেন্দ্র মোদি সরকার আরসেপ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, তারা মনে করছিল এই জোটে তাদের উদ্বেগের কিছু কিছু বিষয় আমলে নেওয়া হচ্ছে না। তবে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, আরসেপ গঠনে নেতৃত্বদানকারীর ভূমিকায় থাকা চীনের স্বার্থই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এটাই ছিল ওই জোট থেকে ভারতের বেরিয়ে আসার প্রধান কারণ।
কিন্তু এখন প্রতিবেশী বাংলাদেশ ওই জোটে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে চিন্তাভাবনা করছে, এই বিষয়টি ভারতের কপালে কিছুটা দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছরেই দুই দেশের মধ্যে ‘সেপা’ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) আলোচনা দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে যে একমত হয়েছিলেন, তার ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আর বছর তিনেকের মধ্যেই বাংলাদেশ এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নীত (গ্র্যাজুয়েটেড) হবে। এর ফলে তারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন যেসব বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে তার অনেকগুলোই হারাবে। এমনকি এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়া অবাধ বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় তারা ভারতের কাছ থেকে যেসব ছাড় পেয়ে থাকে, সেগুলোও আর তখন থাকবে না।
এই পটভূমিতেই বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে এফটিএ সই করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা চালাচ্ছে। এরকম অন্তত ১১টি দেশের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে, যদিও এই মুহূর্তে কোনও দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের পৃথক কোনও এফটিএ নেই।
ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরসেপেও যোগ দিতে পারে সেই সম্ভাবনা খুবই জোরাল। কারণ, সে ক্ষেত্রে চীনসহ বিশ্ববাজারের একটি বিরাট অংশ তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। আবার চীনা পণ্য বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে ফেলতে পারে, সেই সম্ভাবনাও অবশ্য থাকছে।
দিল্লির থিংক ট্যাংক আরআইএসের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি আরসেপে যোগ দেয় সেটা একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলেই মনে করি। হয়তো শ্রীলঙ্কাও খুব শিগগিরই একই রাস্তায় হাঁটবে।’
‘কিন্তু আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির যে জটিল আবর্ত এর পেছনে আছে, সেটা বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশগুলো কতটা সামলাতে পারে সেটাই আসলে দেখার বিষয়’