• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:০৩ অপরাহ্ন

‘কার পাপে’ জাতীয় পার্টির এই পরিণতি?

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : শনিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২৪

১৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। ওই বৈঠকে বক্তৃতা করা ৬০ জন নেতার মধ্যে ৫৯ জন নেতা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার দাবি জানান। একজন নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষ্যে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন। অতঃপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন বনানী দলীয় কার্যালয়ের প্রবেশের সময় দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘ভিক্ষার ২৬ আসন’ নিয়ে নির্বাচনে যাব না। কয়েক ঘণ্টা পর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। নির্বাচনে দেখা যায় ২৬ আসনে সমঝোতা করে নির্বাচনে গিয়ে দলটির গণবিচ্ছিন্নতার মুখে পড়ে। দলটির ৯০ শতাংশ প্রার্থী জামাতন হারিয়েছে তাই নয় এমনো আসন আসে ৪ লাখ ভোটারের আসনে লাঙ্গল প্রার্থী হয়েছে দেড়শ ভোটেরও কম। এখন ১১ আসন নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হওয়ার খোয়াব দেখলেও ইতোমধ্যে দলটিতে কেওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। দলটির ভাঙ্গ ঠেকাকে দু’জন সিনিয়র নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং বিক্ষুব্ধ নেতাদের ভয় দেখিয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। দলটির অনুসারি এবং সুভার্থীদের প্রশ্ন কার পাপে জাতীয় পার্টির এই পরিণতি?

এক সময়ের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির অবস্থা এখন ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ নাটকের মতো। ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনে ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে চরম প্রতিকূল পরিবেশে অংশ নিয়ে ৩৫ আসন পেয়েছিল এবং ৪০টি আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দলটি ’৯৬ সালে সে ধারা অব্যাহত রেখেছিল। সেই দল ২০১৪ সালে জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আসন সমঝোতার নির্বাচন করে সরকারের অংশ এবং একই সঙ্গে জাতীয় সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দল হয়। ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টির অনুকম্পায় সংসদের বিরোধী দল হয়। কিন্তু দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল এবার জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দলটির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের পাপমোচন করা হবে (যদিও নির্বাচনের পর এরশাদ জাতিকে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এর চাপে নির্বাচনে যেতে বাধ্য হয়েছে)। কিন্তু সে পথে না গিয়ে ২৬ আসনে সমঝোতা করে নির্বাচন করে দলটির মুসলিম লীগের মতো ‘হারিয়ে যাওয়া’ দলের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। নির্বাচনে ফলাফলে দেয়া যায় দলটির ৯০ শতাংশ নেতা জামানত হারিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অনেকগুলো আসনে দলটির প্রার্থীরা ১৩৫ থেকে এক হাজার পর্যন্ত ভোট পেয়েছেন। এরপরও দলটি এখন একদিকে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করছে; অন্যদিকে জাতীয় সংসদের ‘পুতুল বিরোধী দল’ হওয়ার লোভে প্রধামন্ত্রীর অনুকম্পা খুঁজছেন।

 

২০১৪ ও ২০১৮ সালে কৌশল করে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ অনেক আগেই সুবিধাবাদের কৌশলে পরাজিত হয়ে ছিটকে পড়েছেন। যদিও তিনি ৩ জন প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিন জনই জামানত হারিয়েছেন। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে জাপার প্রার্থী ২৬৩ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ২৬টি আসনে ‘নিশ্চিত বিজয়’ চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করা হয়। সেসব আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিলেন না। এই ২৬টির মধ্যে জাপা জিতেছে ১১টি আসনে। সমঝোতার বাইরে কোনো আসনে তারা জয় পায়নি। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টির ২৬৩ প্রার্থীর মধ্যে ২৩৬ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। অর্থাৎ লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৯০ শতাংশ প্রার্থী জামানত রক্ষা করার মতো ভোট পাননি। শুধু তাই নয় সমঝোতায় বিজয় নিশ্চিত যে ২৬ আসন ছিল তার মধ্যে আসনগুলো হলো নীলফামারী-৩, রংপুর-১, বগুড়া-৩, পিরোজপুর-৩, ঢাকাণ্ড১৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও চট্টগ্রাম-৮। জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় ২০ হাজার টাকা জামানত দিতে হয়। কোনো প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের এক-অষ্টমাংশের কম ভোট পেলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। তবে বিজয়ী ১১ জনের বাইরে ১৬ জন জামানত রক্ষা করতে পেরেছে। দলটির প্রার্থীদের ১৯৫ জন ৫ হাজারের কম ভোট পেয়েছেন। এর মধ্যে ৮৮ জনের ভোট এক হাজারের কম। সারা দেশে সব প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ২১ লাখ ৬৮ হাজার ২২১ ভোট।

ইসির তথ্যে দেখা যায়, জাপার প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে কম ১২৪ ভোট পেয়েছেন সিলেট-৫ আসনে শাব্বীর আহমদ। চট্টগ্রাম-৩ আসনে এম এ ছালাম পেয়েছেন ১৩৫ ভোট, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে আবু জাফর মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ ১৬২ ভোট ও নরসিংদী-৩ আসনে এস এম জাহাঙ্গীর পাঠান পেয়েছেন ১৮৯ ভোট।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক হয়ে অংশ নেয় জাপা। এরপর ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোট করে দলটি। নির্বাচন কমিশন জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৭৮টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৪৫টি আসনে জামানত হারিয়েছিল। এর আগে বিএনপিবিহীন ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে ৩৪ জন এমপি হয় তবে ২০টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। ওই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়।

জন প্রত্যাশার বিপক্ষে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজের অবস্থান দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার করেছে জাতীয় পার্টি। কারণ দলটিকে এতোদিন বড় দল ‘কাগুজে বাঘ’ মনে করা হলেও দলটির জনসমর্থন কার্যত তলানিতে ঠেকেছে। জনসমর্থনের তালিকায় জাতীয় পার্টির অবস্থান এখন জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন ও সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ে খারাপ অবস্থানে। এই দুই বাম দলের নেতাদের মানুষ যে মর্যাদা দেয় জাতীয় পার্টির নেতাদের সে মর্যাদা দেয় না। বরং সাধারণ মানুষ জাতীয় পার্টির নাম শুনলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে জাপাকে নিয়ে যে সব শব্দের লেখালেখি হচ্ছে তা গণমাধ্যমে ছাপার অক্ষরে লেখা সম্ভব নয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রমাণ হয়ে গেছে এরশাদের হাতে গড়া জাতীয় পার্টির গণভিক্তি নেই। এতোদিন রংপুরে জন সমর্থন রয়েছে প্রচার করা হলেও বাস্তবে সেটাও হারিয়ে ফেলেছে দলটির সুবিধাবাদী কর্ম কৌশলের কারণে। এরই মধ্যে দলটির অভ্যন্তরে কামড়াকামড়ি শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনের পর দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে সরকারের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা নির্বাচনী খরচ হিসেনে নেয়ার অধিযোগ তুলে দলটির বনানীর ‘রজনীগন্ধা’ নামক কার্যালয় ঘেড়াও করা হয়। সেখানে দলটির নেতারা নির্বাচনী খরচ তসরুপের অভিযোগে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে পদত্যাগের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। এর মধ্যেই দলটির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে জাপা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল দলটির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কাজী ফিরোজ রশীদ ও সুনীল শুভ রায়কে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও প্রেসিডিয়াম সদস্য পদসহ দলীয় সকল পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। যা ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় সুনীল শুভ রায় ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টে এক স্ট্যাটাসে লেখেন- মিডিয়া সূত্রে জানতে পারলাম কা-চু পরিচালিত ‘জাতীয় পার্টি’ নামের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমার কাছে এই অব্যাহতি পত্র কচু পাতার চেয়েও মূল্যহীন। দলটির বহিষ্কৃত এই সিনিয়র নেতার বক্তব্যে বোঝা যায় জাতীয় পার্টি নামের দলটির অবস্থান কোন পর্যায়ে। দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নাম শুধু ‘কা’ এবং মুজিবুল হক চুন্নুর নাম ‘চু’ ব্যবসার করা হয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের নাম নিয়ে দলের নেতারা খিস্তি-খেউর করেন।

দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ১০-১২ জন নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানান, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম এইচ এম এরশাদ চাপে পড়ে ২০১৪ সালে নির্বাচন করে যে পাপ করেছেন; সেটা মোচনের সুযোগ ছিল এবার নির্বাচনে না গিয়ে জনগণের পক্ষ্যে অবস্থান নেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু লোভী কয়েকজন নেতা এমপি মন্ত্রীর লোভ এবং জাতীয় সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হওয়ার লোভে ২৬ আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। অথচ নির্বাচনে আগে কার্য নির্বাহী কমিটির এক সভায় ৬০ বক্তার মধ্যে ৫৯ জন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার ঘোষণা দেন। এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন ‘ভিক্ষার ২৬ আসন’ নিয়ে নির্বাচনে যাব না ঘোষণা দিয়ে বনানীর অফিসে প্রবেশ করেন। কিন্তু তিন ঘণ্টার পর তিনি ঘোষণা দেন জাপা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কার্যত জাতীয় পার্টির নেতারা লোভে পড়ে রাজনীতির পথ হারিয়ে ফেলেছে।

জাপার সতর্ক বিজ্ঞপ্তি : দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জাতীয় পার্টি (জাপা) কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর এবার এক জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে দলটি। শুক্রবার দলটির যুগ্ম দফতর সম্পাদক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত এ জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর আহ্বান ছাড়া অন্য কারো আহ্বানে দল সংশ্লিষ্ট ঢাকায় কোনো সভা, সমাবেশ কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করতে কেন্দ্রীয়, জেলা, মহানগর ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে জাতীয় পার্টি।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, জাতীয় পার্টির সব স্তরের নেতাকে কোনো কুচক্রী মহলের অবৈধ ও অসাংগঠনিক প্ররোচণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ