• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৩ অপরাহ্ন

আর কতদিন গরুতে ইট খাবে?

আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭

গবু চন্দ্র সরকারের বড় কর্মকর্তা। গবু সাহেবের একমাত্র কন্যার বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে। একজন ইয়া বড় রাজনৈতিক নেতার একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিয়ে। সাত শহরের লাখো মানুষকে খাওয়াতে হবে। পাত্রপক্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গবু সাহেবকেও উপহার উপঢৌকনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিন রাত গবু সাহেবের ঘুম হয়নি। আর গবু ম্যাডাম তো রেগে অগ্নিগিরি—তার এক অকর্মা, বেহুদা স্বামী জুটেছে! যার জন্য তাঁর মান-সম্মান সবই খোয়াবার জোগাড়। গবু সাহেব কূলকিনারা না করতে পেরে সকালে অফিসে ঢুকেই ডেকে পাঠালেন তার বিশ্বস্ত অধস্তন হবু সাহেবকে। হবু সাহেব সব শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। তারপর গবু সাহেবকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন, “বড় সাহেব আপনার মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড়ের দায়িত্ব আমার। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়িতে গিয়ে মেয়ের বিয়ের এন্তেজাম করুন।” হবু সাহেব সব জেলার কর্মকর্তাদের বললেন, যে করে হোক কাল সকালের মধ্যেই তার ২০ লাখ টাকার দরকার। সবাই সময় চাইলেন কিন্তু লালপুর জেলার মহাকর্তা জানিয়ে দিলেন—মহাশয়, আজ রাতেই আপনার কাছে ২০ লাখ টাকা পৌঁছে যাবে। লালপুর জেলার মহাকর্তা তার একান্ত সহকারীকে নির্দেশ দিলেন ভবন নির্মাণের জন্য সরকারের কেনা ১২ লাখ ইটের ১০ লাখ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিক্রি করে টাকাটা তার হাতে পৌঁছানোর জন্য। করিত্কর্মা সহকারীর এতো হাতের ভেলকি। মাত্র দু’ঘণ্টায় ১০ লাখ ইট বিক্রির ২৫ লাখ টাকা পেয়ে গেলেন জেলার মহাকর্তা। পাঁচ লাখ হাতে রেখে পৌঁছে দিলেন ২০ লাখ টাকা হবু সাহেবের কাছে। হবু সাহেবও তো কম নন—হাতে পাঁচ লাখ রেখে বাকিটা জমা দিলেন মহাকর্তা গবু সাহেবের কাছে। ঘটনা চাপা থাকল না। কদিন পরেই পত্রিকার পাতায় খবর চলে এল। সরকারের মন্ত্রী মহোদয় কমিশন গঠন করলেন এই ইট চুরির তদন্তের জন্য। গবু সাহেবের তো মাথায় হাত। ভয়ে রইলেন, এই বুঝি তার চাকরিটা গেল! সেই সঙ্গে মেয়ের বিয়েটাও ভেঙে যাবার আশঙ্কায় রাতে ঘুমুতে পারলেন না তিনি। সকালেই সাহায্য চাইলেন হবু সাহেবের। হবু সাহেব লালপুরের অধিকর্তাকে জানালেন, যে করে হোক এই যাত্রায় বাঁচবার পথ বের করতে হবে। লালপুরের মহাকর্তা আবারো আশ্বস্ত করলেন তাঁর ঊর্ধ্বতন হবু সাহেবকে। তার করিত্কর্মা সহকারীকে ডেকে নির্দেশ দিলেন যে করে হোক প্রমাণ করতে হবে তারা নির্দোষ। আজ তদন্তের দিন। করিত্কর্মা সহকারী তার লোকবলকে এলাকার সব গরু ইট সংরক্ষণের এলাকায় যেখানে তদন্ত কমিটি আসছে সেখানে আনবার নির্দেশ দিলেন। আর জেলার সব মনোহারী দোকানের কয়েক মণ নালীগুড় কিনে আনালেন। ইটের উপর ছিটিয়ে দেওয়া হলো একই রঙের সেই নালীগুড়। গরুগুলো নালীগুড়ের স্বাদে মত্ত হয়ে চাটতে লাগল বিক্রির পর অবশিষ্ট ইটগুলো। লালপুরের মহাকর্তা তদন্ত কমিটিকে দূর থেকে দেখিয়ে দিলেন গরুতে ইট খাওয়ার দৃশ্য। শক্ত করেই বললেন, এই গরুগুলোই ১১ লাখ ইট খেয়ে ফেলেছে, পড়ে থাকা বাকি ইটগুলোও দ্রুত সাবাড় হয়ে যাবে। ধন্য হলেন গবু সাহেব। নিষ্কলঙ্কই থেকে গেলেন গবু, হবু আর লালপুরের মহাকর্তা। বাড়তি ইট বিক্রির পাঁচ লাখ টাকাও তাঁরা পকেটে পুরলেন মহানন্দে। তদন্ত রিপোর্ট বেরুল। বলা হলো, “আজকাল হাভাতে গরুরা সব কিছু ফেলে ইটে বেশি তৃপ্তি পাচ্ছে। আর সে কারণেই লালপুরে মাত্র সাত সপ্তাহে সরকারের ফেলে রাখা ১২ লাখ ইটের ১১ লাখই গরুতে খেয়ে ফেলেছে। বাকি এক লাখও এ সপ্তাহেই নাই হয়ে যাবে”।

এটি একটি কাল্পনিক ঘটনা। তবে আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অসঙ্গতি আর অন্যায়-অবিচারগুলোর সঙ্গে এর দূরত্ব যে খুব বেশি নয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই স্বীকার করবেন। চতুরতার আবর্তে চোখের নিমেষেই বহু গুরুতর অন্যায় অনিয়ম এবং জনগণের সমপদ আত্মসাতের ঘটনা অলৌকিকভাবে সহজেই হয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ, সঠিক। এসব দেখলে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। ক্ষোভে ও ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে হয় যখন শুনি বাংলাদেশের, বাঙালির অহংকার মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতি করেছেন দেশের উপরের সারির কর্মকর্তারা, বিদেশি গুণীজনদের জন্য দেওয়া পদকেও ঘটেছে সোনা চুরির ঘটনা। অফিস, আদালত, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষালয়, হাসপাতাল, পরিবহন, খাদ্যগুদাম কোথায় নেই অনিয়ম আর দুর্নীতি! কিন্তু কেন যেন সবার চোখ অন্ধ। আমরা দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না। কেন এই নীরবতা? সব মেনে নেওয়ার নতজানু মানসিকতা? সময় এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। দেশটাকে আর বিশ্বটাকে নতুনরূপে সাজাবার জন্য আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন প্রজন্ম। তাদের আলোকিত পথের দিশা দেবার দায়িত্ব আমাদের সবার।

n লেখক :প্রবাসী বিজ্ঞানী


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ