• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৩ অপরাহ্ন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অবহেলা নয়

আপডেটঃ : রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭

আমাদের দেশে একসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কল্পনা বা ধারণারও অতীত ছিল। কিন্তু অনেক কিছুই সময়ের প্রয়োজনে শুধু প্রতিষ্ঠাই পায় না, মাথা উঁচু করেও দাঁড়ায়। সেটা শিক্ষা, শিল্প কিংবা আন্দোলন-সংগ্রাম যে কোনো ক্ষেত্রেই হতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও বর্তমানে একথা প্রযোজ্য। একসময় বিশ্ববিদ্যালয় মানেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বোঝানো হতো। এবং সেটিই বাস্তব ছিল। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আসন বা ধারণ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে অসম পর্যায়ের। শিক্ষার্থীর তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা অপ্রতুল। সে কারণে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী ইচ্ছে-অনিচ্ছেই দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যেতো। এতে করে দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ একটা অর্থ বাইরে চলে যেতো। এতে দেশের অর্থনীতি যেমন ক্ষতির শিকার হতো, ঠিক একইভাবে এসব শিক্ষার্থী বিদেশি সংস্কৃতি মন ও মননে গেঁথে নিয়ে দেশে ফিরে আসতো। অনেকে আসতোও না। এতে করে তাদের মধ্যে খাঁটি দেশপ্রেমে খানিকটা ঘাটতি থেকে যেতো। যেটা সহজেই পূরণীয় সম্ভব হয় না। এসব নানাদিক বিবেচনায় এনে নব্বই দশকের দিকে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযাত্রা ঘটে। নিন্দুকদের বিষ-তীর, নানামুখী সমালোচনা ও অসহযোগিতাকে মেনে নিয়েই এদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এসবের থেকেও বড় সমস্যা ছিল একেবারে প্রথম পর্যায়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের ব্যাপারটি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত্ নষ্ট হয়ে যাবে কী না— অভিভাবকদের মধ্যে এরকম আশঙ্কা তখন খুব জোরালো ছিল। শিক্ষার্থীরাও ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ প্রতিষ্ঠার শুরুতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে ‘কোচিং সেন্টার’ তকমাটি লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। যে তকমাটি থেকে এখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি বেরুতে পারেনি। সেই তকমাটি শুধু-শুধুই লেপে দেয়া যায় কী না, নাকি এরও বিশেষ কোনো যৌক্তিকতা নিহিত আছে— তাও ভাবার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, দেশের প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নামি-দামি শিল্পোদ্যোক্তারা। তাদের মূল লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার মান উন্নতকরণ না কি শিক্ষাকে বাণিজ্যমুখীকরণ! কারণ এসব শিল্পোদ্যোক্তার কাজ-কারবার সবই মুনাফামুখী। ফলে তাদের হাতে শিক্ষার মান সত্যিকার অর্থে কতোটা গুরুত্ব পায়— এসব প্রশ্ন তখন বেশ জোরেশোরেই উচ্চারিত হয়েছে, এখনো অমূলক নয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যমুখী বিষয় (সাবজেক্ট)গুলোকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। বিশেষ করে যে বিষয়গুলো চাকরির বাজারে গুরুত্বপূর্ণ বা চাহিদাসম্পন্ন। বাংলা, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি এমনকি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিতের মতো বিষয়ও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপাংক্তেয়। গুরুত্বহীন। কারণ এসব বিষয়ের খুব একটা বাজারমূল্য নেই। কোনোটার হয়তো একদমই নেই। চাকরির বাজারে দাম নেই— এমন বিষয় চালু করলে, ভর্তুকি যদি দিতে হয়— এই আশঙ্কা থেকেই এসব বিষয়ভিত্তিক বিভাগ চালু করা হয় না। এই ধারণা যদি সত্য বলে ধরা হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানও তো বাণিজ্যমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানেরই গোত্রভুক্ত হয়ে পড়ে। অধিকাংশ উদ্যোক্তাই এক্ষেত্রে সাবধানী থাকেন। আবার  বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ভিত্তিক বিভাগ না থাকলে, সেটি কীভাবে আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখে! এসব আশঙ্কা বা প্রশ্ন থেকেই হয়তো অনেকেই একবাক্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীনভাবে ‘কোচিং সেন্টার’ তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন।

 

দেশে বর্তমানে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর কয়টিতে বাংলা বিভাগ আছে? বাংলা বিভাগ বাদে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে হয়! আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে! ইংরেজি কোর্স কারিক্যুলামের মধ্যে বাংলা বিষয়ের ১০০ নম্বরের একটি কোর্স অন্তর্ভুক্ত করে দিলেই কী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পুরোটা দায়িত্ব পালন হয়ে যায়! চলছে তো এরকমই। সব দেশেই তো তার নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও ভাষা সম্পর্কে জানতে হয়। এই জানাটা বাধ্যতামূলক। তাহলে আমাদের এখানে এ বিষয়ে এতো উদাসীনতা কেন! অনেক দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল বিভাগে ১০০ নম্বরের বাংলা ভাষা পড়তে বাধ্য করেছে। যা শিগগিরই কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়। ইউজিসি এ বিষয়ে খুব জোরালোভাবে কাজ করছে। নিঃসন্দেহে ইউজিসির এটি একটি  যুগান্তকারী উদ্যোগ। ইউজিসি বাংলা ভাষা কোর্স বাধ্যতামূলক চালু করার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি এ বিষয়ক প্রায় সব কাজই ইতোমধ্যে শেষ পর্যায়ের দিকে নিয়ে এসেছে। এই কমিটির অন্যতম একজন সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। তিনি জানালেন, ‘বাংলা ভাষা কোর্সটি চালু করা বিষয়ক বিশেষ করে সিলেবাস প্রণয়ন, গ্রন্থ রচনা এসব কাজই একেবারে শেষ পর্যায়ে। আশা করছি, স্প্রিং সেমিস্টার ’১৮ অর্থাত্ ২০১৮-র জানুয়ারি থেকেই ‘বাংলা ভাষা’ কোর্সটি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা যেতে পারে।’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ইউজিসি অসামান্য অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে তার নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে হবে। এটি পুরোটা বাস্তবায়ন হলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারা অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবে। আশা করাই যায়, তখন ‘পাবলিক’ আর ‘প্রাইভেট’ এসব গুরুত্বহীন হয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বকীয় মর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

 

সময়ের সিঁড়ি ধরে একদিন হয়তো দেশের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি ও সম্মান কেড়ে নেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই। সেদিন কি খুব বেশি দূরে! পৃথিবীর বহু দেশেই বর্তমানে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত। আবার এটিও চরমভাবে সত্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদেরও অতি বাণিজ্যমুখী চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দেয়া প্রয়োজন। আবার এরকম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে, যেখান থেকে উদ্যোক্তারা একটি টাকাও গ্রহণ করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নেই তা ব্যবহূত হয়। সময়ের জালে বন্দি করে কর্পোরেট অফিসের আচরণ প্রতিষ্ঠিত করে শিক্ষকদের যেমন ভালো গবেষক বানানো সম্ভব নয়, শিক্ষার্থীদেরও উন্নতমানের গবেষণাকর্মে যুক্ত করা যায় না। ভালো শিক্ষা প্রদানও করা যায় না। তবে  কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার উন্নত গুণগতমান ও গবেষণা কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন ও অব্যাহত থাকলে এদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুব দ্রুতই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ও আস্থার জায়গা হয়ে উঠবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ