হিসাবমতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৯-এ অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে রাজনীতির মাঠ একটু একটু সরগরম হতে চলেছে। আর ঘরপোড়া মানুষ বিভিন্ন পক্ষীয় রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতার ভাষা শুনে মাঝে মাঝে আতঙ্কবোধ করছে। সে আতঙ্ক তিন রকম। যেমন— ১. নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কিনা, ২. বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে—না গেলবারের মতো ফাঁদ তৈরি করবে, ৩. আবার নৈরাজ্যের পথে হেঁটে অন্যপথে ক্ষমতায় আসার ফাঁদ তৈরি করতে চাইবে কি না।
রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতার ভাষার সব কিছুর অর্থ আমি বুঝি না। তাদের কেউ কেউ যুক্তিহীন উল্টাপাল্টা কথা প্রায়ই বলেন। সমালোচিত হলে পাশ গলে বেরিয়ে যাওয়ার মতো একটি শব্দ তাঁদের মুখেই থাকে। তা হচ্ছে, ‘ওসব তো রাজনৈতিক বক্তব্য’। অর্থাত্ ওসব সিরিয়াস কথা নয়, বা অসত্য কথা। এসব কথা ধরতে নেই। নিজ কর্মী সমর্থকদের উজ্জীবিত করার জন্য এসব বলতে হয়। মাঝে মাঝে ভাবি সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা কি এতটাই নির্বোধ? জগত্ সংসার সম্পর্কে কোনো খোঁজ রাখেন না! সময় অনেক এগিয়েছে। জগত্ জীবনের অনেক তথ্য তারা মোবাইল ফোনের বোতাম টিপেই পেয়ে যায়। সুতরাং এই ডিজিটাল যুগে সাতপুরোন এনালগ ধারার বক্তৃতা খুব কি কাজে লাগবে? উল্টো প্রতিক্রিয়াও তো হতে পারে!
একটি টাটকা উদাহরণ দেই। গত ২৫ অক্টোবর বিএনপির মহাসচিব দলীয় একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে পক্ষান্তরে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থাই যেন প্রকাশ করলেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখালেন না। শুধু মনগড়াভাবে বললেন, নির্বাচন কমিশন হবে সরকারের আজ্ঞাবহ। হয়ত জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম সাহেবকে চেপে ধরলে বলবেন— এটি আসলে তাদের ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’। ঘটনাচক্রে এই সভায় আমার পরিচিত একজন বিএনপি কর্মী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে বিএনপি অন্তঃপ্রাণ। অমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া তার কাছে জানতে চাইলাম। খুব বিষণ্ন হয়ে বললেন, ‘নেতারা এভাবে কথা এখন না বললেই পারতেন। অনেকদিন পর সবে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। চাচ্ছি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলকে আবার শক্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে। বিভ্রান্তি ছড়ানোর সময় তো এটা নয়।’ আমার অন্য প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় না বেশিরভাগ বিএনপি কর্মী এখন আর এধারার বক্তব্য শুনতে চায়।’
আমি এ জায়গা থেকেই পাঠকের সামনে আজকের লেখাটি উপস্থাপন করতে চাই। ২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পক্ষেরই বক্তব্য ছিল। টিভি চ্যানেলের কল্যাণে দেশবাসী তা শুনেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মনে যাই থাক, অত্যন্ত সংযতভাবে যথার্থ রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের সার কথা হচ্ছে, নির্বাচন তো সরকার করে না, করে নির্বাচন কমিশন। সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়। তাই নির্বাচনকালীন কোনো সরকারের প্রয়োজন নেই। এধরনের সরকার করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। তিনি সংশোধনের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। বিএনপি মহাসচিব জোরালো কণ্ঠে নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাঁর আস্থাহীনতার কথাই জানিয়েছেন। সদ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজসহ অন্যান্য সংগঠন। পাঁচশ’র বেশি প্রস্তাব জমা পড়েছে। এই পর্যায়ে এখনো কোনো পক্ষ অস্বস্তি প্রকাশ করেনি। বিএনপিও সংলাপের সময়ে এবং সংলাপ শেষে বেরিয়ে এসে তেমন বিরুদ্ধ বক্তব্য দেয়নি। সচেতন দেশবাসী আগ্রহের সঙ্গে এসব পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ সকলেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের কাঠামোকে শক্তিশালী দেখতে চায়। চায় নানা ছুতোনাতায় যেন নির্বাচন ভণ্ডুল বা বিতর্কিত হয়ে না যায়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য দায়িত্বশীল সকল রাজনৈতিক দলের সক্রিয় ও ইতিবাচক ভূমিকা প্রয়োজন। অন্যতম বড় বিরোধী দল বিএনপির কাছে একারণে মানুষের প্রত্যাশা বেশি।
এমন এক বাস্তবতায় বিএনপি মহাসচিবের বক্তৃতা মানুষকে হতাশ করবে নিঃসন্দেহে। তিনি নির্বাচন কমিশনের উপর বিষোদ্গারের আগে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ উত্থাপন করলেন না। সংলাপ শেষেও তেমন অভিযোগ করেননি। এত যে দল-মতের মানুষ সংলাপ করলেন কারো কাছ থেকে এখনো তেমন বিরুদ্ধ মন্তব্য আমরা শুনিনি। হঠাত্ এ কয়দিনে কেন আস্থার সংকট হলো তাও উল্লেখ করলেন না। কেবল অনুমাননির্ভর কথা বলে গেলেন। কিন্তু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বুঝতে চাইলেন না মানুষ এখন সুস্থ নির্বাচনের পথ তৈরির জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সকল পক্ষের সহযোগিতামূলক আচরণ দেখতে চায়।
মানতেই হবে এবার নির্বাচনের আগে বিএনপির আচরণ মানুষ বেশি লক্ষ রাখবে। সেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার নামে বিএনপি-জামায়াতের ভয়ঙ্কর মর্মান্তিক তাণ্ডবের কথা মানুষ ভোলেনি। বিএনপি এবং তার বন্ধুদের হয়ত পরিকল্পনা ছিল একটি তাণ্ডব তৈরি করে গোলমেলে অবস্থার মধ্য দিয়ে অন্যপথে ক্ষমতা দখল করবে। কিন্তু লক্ষ পূরণ না হওয়ায় কী পরিণতি বহন করতে হয়েছে তা বিএনপি নেতা-নেত্রীর চেয়ে আর কে ভালো জানে! এই বাস্তবতায় নির্বাচনের মাঠে সরব হওয়ার আগে বিএনপি নেতৃত্বের উচিত ছিল নির্বাচন প্রশ্নে মানুষের মনে আস্থার জায়গায় ফিরে আসা। একারণে প্রয়োজন ছিল হিসেবি ও কৌশলী বক্তব্য রাখা। তার বদলে বিরোধী দলীয় স্থূল ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে কি মানুষের আস্থার জায়গায় আসা যাবে!
আমরা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পূর্ব সময়টিকে স্মরণে আনতে চাই। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা থাকলেও আশা থেকেও দূরে সরে যায়নি। দুই বড় দলই জানতো নির্বাচনে না যাওয়াটা কারো জন্য সুখপ্রদ হবে না। দূরত্ব যেটুকু ছিল তা হচ্ছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বদলে যে করেই হোক রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়াটার দিকেই পরস্পরের উদগ্র ঝোঁক। শুরুতেই কোনো ধরনের স্পেস না দিয়ে দুই দলের নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে পারস্পরিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান এবং আল্টিমেটাম পর্যায়ে চলে যাওয়া। অতঃপর নানা দ্বিধা, জড়তা, নিজ অনড় অবস্থানে থাকতে না পারার এক ধরনের গ্লানিবোধ সমাধানের পথটাকে বন্ধুর করে তোলে। তখন অনন্যোপায় হয়ে দরকার পড়ে মধ্যস্থতাকারীর। তবে দেশি মধ্যস্থতাকারী হলে লজ্জার ঘোর কাটে না। তাই স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাজনীতিকরা বিদেশি মধ্যস্থতাকারীদের ওপর আস্থা রাখেন। তবুও মানুষ এমন দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। নিজের নাক কেটে যদি যাত্রাপথ কণ্টকমুক্ত হয় সেটাও গণতন্ত্র রক্ষায় ইতিবাচক বলে মনে করা যেতে পারে।
নির্বাচন আসন্ন হলে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষেই উত্সাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। নানা ধরনের প্রস্তুতি আয়োজনে নিবিষ্ট থাকেন অনেকে। যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তাঁরা এ সময় ঘরমুখো হন। নির্বাচনী এলাকায় ব্যস্ত থাকেন জনসংযোগে। কর্মীদের মধ্যেও সাজ সাজ রব ওঠে। আলোতে প্রস্তুতির পাশাপাশি অন্ধকার প্রস্তুতিও চলতে থাকে সমান তালে। সরকারি দল বাড়তি সুবিধা নিতে ব্যস্ত রাখে সরকারযন্ত্রকে। কোন কর্মকর্তাকে কোথায় বদলি করলে সুবিধা হবে, পুলিশ প্রশাসনের রদবদল কেমনতর করা বিধেয় হবে, ইত্যাকার নানা কর্মতত্পরতায় ঘর্মাক্ত থাকতে হয়। সাধারণ ভোটারের মধ্যে দেখা যায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের অনেকে নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে কোনো এক অশনি সংকেতে তত ভীত হতে থাকেন। যে বরেণ্য ব্যক্তিদের নাম কখনো কখনো শুনেছেন এখন প্রার্থী হিসাবে তাদের নিজ ধরণীতে দেখে অতি আপনজনের মতো কথা বলতে শুনে আহ্লাদিত হন। পাশাপাশি বিগত দিনের হিসাব কষে কেউ কেউ নিজের ভোটের জন্য সঠিক বাক্স শনাক্ত করেন। সকল দলের ক্ষেত্রে এই তো হচ্ছে সাধারণ চালচিত্র।
কিন্তু সেই নির্বাচনে বিএনপি যেন প্রাক সিদ্ধান্ত নিয়েই ছিল নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তাঁরা অন্যপথে হাঁটবে। তাই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে বিরোধীদলের অংশীদারিত্ব রাখার ব্যাপারে সরকারি ঘোষণার পরও বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণাকে সামনে রেখেই পথে নেমেছিল। এরপর রাজনীতির মাঠে অনেক পানি গড়িয়েছে। বিএনপির শিক্ষাও কম হয়নি। এসব কারণে সকলের ভাবনা ছিল এবার নির্বাচনের মাঠে বিএনপি নেতাদের আচরণ ভিন্ন হবে। অনেক বেশি যৌক্তিক এবং দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু সূচনা বক্তব্যগুলোতে মনে হচ্ছে পুরনো ঘূর্ণিতেই ঘুরছে বিএনপি।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে সবে নির্বাচনী যাত্রা শুরু হয়েছে। এখনই তথ্যসূত্র ছাড়া সমালোচনার সময় আসেনি। আমাদের সতর্ক থাকা উচিত, কোনো অপ্রয়োজনীয় আচরণ ও বক্তব্যে নির্বাচনের সরল পথ যেন কণ্টকাকীর্ণ না হয়। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোনো পক্ষের তেমনটি করা উচিত হবে না। নির্বাচন কমিশন এসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। যদি এমন দিন আসে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়ার মতো কর্ম করে নির্বাচন কমিশন তবে নিশ্চয়ই রাজনীতিকগণ সরব হবেন। প্রতিবাদ করবেন। চাই কি কমিশনের বিরুদ্ধে অনাস্থাও আনতে পারেন। কিন্তু এত আগে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ কেন! সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এত উষ্মা প্রকাশ কেন! তবে কি মানুষ আতঙ্কের সঙ্গে ভাববে এবারো বিএনপির অন্য উদ্দেশ্য আছে? আমাদের অবশ্য ভাবতে ইচ্ছে করে, বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয় আত্মঘাতী হওয়ার পথে হাঁটবেন না।