ভোরবেলা বয়ে যাচ্ছে হালকা হিমেল বাতাস। ঘুমের ঘোরে থেকেও কাঁথা জড়াতে হচ্ছে। ঘরের বাইরে গেলে হিম হিম ঠান্ডা জড়িয়ে ধরে শরীরের চারপাশ। তাই সাতসকালে একটি প্রশ্ন মনে জাগতে পারে, শীত কি তাহলে চলে এল?
অক্টোবর মাসের কয়েক দিনে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য দেখে শীতের আগমনী বার্তাই পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, মৌসুমি বায়ু এই মাসের প্রথমার্ধে বিদায় নিয়েছে। নিম্নচাপের প্রভাবে ১৯ থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত টানা তিন দিনের বৃষ্টি। এর পরই যেন প্রকৃতির আচরণ বদলে যেতে থাকে। কমে আসে বৃষ্টির দাপট। ছিটেফোঁটা, কোথাওবা বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির দেখা মিললেও কয়েক দিন ধরে শুষ্কই রয়েছে দেশের বেশির ভাগ এলাকা। এর সঙ্গে আবার তাপমাত্রাও কমছে অল্প অল্প করে।
২ অক্টোবর দেশে সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ২৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি। রাজধানী ঢাকায় ছিল ২৫ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৯ দিনের ব্যবধানে আজ সোমবার সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ফেনীতে ১৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঢাকায় ছিল ২১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাজারহাটে ছিল ২১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের প্রায় সব এলাকায় তাপমাত্রা ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে এসেছে।
আবহাওয়াবিদদের মতে, তাপমাত্রা আরও কমে আসার প্রবণতা থাকবে। কারণ, মৌসুমি বায়ু বিদায় নেওয়ার পর সূর্যের আলো এখন তির্যকভাবে পড়তে শুরু করেছে। আর বাংলাদেশে শীত অনুভূত হয় সূর্যের অবস্থানের কারণে। বছরের এই সময়টায় সূর্যের কিরণকালও কমে যায়।
এসব কথা জানিয়ে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মানুষের শরীরে সবচেয়ে আরাম অনুভূত হয়ে থাকে। এর নিচে তাপমাত্রা কমে এলে শীত শীত লাগতে শুরু করে। তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে শীত ও অস্বস্তি লাগে। এখন থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম পক্ষ থেকে গরমের তীব্রতা আর অনুভূত হবে না। কারণ, এই মাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার সঙ্গে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাবে।
সারা দেশের তাপমাত্রা যেমন কমতে শুরু করেছে, তেমনি হালকা কুয়াশাও পড়ছে দেশের কোথাও কোথাও। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, নভেম্বর মাসের শুরু থেকে দেশের উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে নদী অববাহিকায় হালকা কুয়াশা পড়তে পারে। এসব এলাকায় দৃষ্টিসীমা গড়ে ৮০০ মিটার থেকে এক কিলোমিটার থাকে। কোথাও কোথাও এটি ৫০০ থেকে ৮০০ মিটারে নেমে আসে। কুয়াশা বেশি পড়ার আশঙ্কা থাকায় ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দৃষ্টিসীমা ১০০ থেকে ২০০ মিটারে নেমে আসতে পারে।
এই কুয়াশার সঙ্গে যদি বাতাস বয়ে যায়, তাহলে শীত অনুভূত বেশি হয় বলে জানান আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই তিন মাসকে শীতকাল বলা হয়। তবে নভেম্বর মাসে শীত পড়ে থাকে। দিনের ব্যাপ্তি কম থাকে। তখন সূর্য ডুবে গেলে ভূপৃষ্ঠ তাপ ছেড়ে ঠান্ডা হয়। এর সঙ্গে কুয়াশা ও হালকা বাতাস বয়ে গেলে শীত পড়ে। এটিকে বিকিরণের মাধ্যমে ঠান্ডাজনিত কুয়াশা বলা হয়। নভেম্বর মাসের এই সময় স্বাভাবিক মাত্রার শীত পড়ে থাকে। তখন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ থেকে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
বাংলাদেশে হাড় কাঁপানো শীত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পড়ে থাকে। তবে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর নিচে নামার রেকর্ড আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৬৪ বছরের মধ্যে দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল শ্রীমঙ্গলে ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৪ সালের ২৭ জানুয়ারি ঈশ্বরদীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল দিনাজপুরে ৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় ১৯৫৩ সালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর নগরায়ণের প্রভাবে রাজধানীর ঢাকার তাপমাত্রা আর কমেনি।
আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সমান বা এর নিচে নেমে এলে তাকে শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়ে থাকে। ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ এবং ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমা বাতাসের প্রভাবে বাংলাদেশের শীতকালে ঠান্ডা পড়ে থাকে। তবে এটি শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর নিচে কমে যায় না। কারণ, সাইবেরিয়ার বাতাস এ দেশে আসতে আসতে এর ঠান্ডা ভাব কমে যায়। হিমালয় পর্বতমালার কারণে কিছুটা ঠান্ডা পড়ে। কখনো কখনো তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে চলে এলেও এর স্থায়িত্ব অল্প সময়ের জন্য। হিমালয় না থাকলে সাইবেরিয়ার বাতাস সরাসরি বঙ্গোপসাগরের দিকে চলে যেত।