৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ও গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের যুদ্ধ ঘোষণার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো বলতে গেলে দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক প্রান্তে রয়েছে যারা ‘ইসরাইলের পক্ষে’ দাঁড়ানোর দাবি করেছে, সরকারি ভবনগুলোতে ইসরাইলি পতাকা ওড়াচ্ছে, সামরিক অভিযানে সমর্থন দিচ্ছে এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গাজার বেশির ভাগ অংশ সমতল করে দেয়া ও ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার পরও সমালোচনা এড়িয়ে চলেছে। চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি এই শিবিরে দাঁড়িয়ে আছে, তারপর জার্মানি রয়েছে। ‘শান্তির পক্ষে’ও একদল সোচ্চার। তারা আবার হামাসের তীব্র নিন্দা করার সাথে সাথে যুদ্ধবিরতিরও আহ্বান জানায়। ইসলামী চেতনার ভীতি থেকে তারা হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ বলছে। মানবিক আইন লঙ্ঘনের জন্য প্রকাশ্যে ইসরাইলের সমালোচনাও করছে। বেলজিয়াম, স্পেন ও আয়ারল্যান্ড এই মধ্যপন্থী শিবিরের সোচ্চার সদস্য, তারপরে ফ্রান্স এবং আরো কয়েকটি দেশ।
বাস্তবতা হলো- ইইউতে সরকারের পর্যায়ে ফিলিস্তিনপন্থী কোনো শিবির নেই : তাদের কেউই ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন করেনি, ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও ধ্বংসাত্মক গাজা আক্রমণের নিন্দা করেনি। একমাত্র সোচ্চার ব্যতিক্রম হতে পারে স্পেনের বামপন্থী সুমার পার্টির উপ-প্রধানমন্ত্রী ইয়োলান্ডা ডিয়াজ, যিনি ‘ইসরাইলি বর্ণবাদের’ নিন্দা করেছেন এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন। তথাপি তার বক্তব্য সামগ্রিকভাবে সরকারের অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে না।
ইইউর সামগ্রিক অবস্থান ইসরাইল-জোটবদ্ধ, মধ্যপন্থী এবং মধ্যবর্তী শিবিরগুলোর মধ্যে শক্তির ভারসাম্যের ফলাফল। ৭ অক্টোবরের পর থেকে ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রসহ ইইউর সাধারণ বিবৃতিগুলো ইসরাইলঘনিষ্ঠ শিবিরের অবস্থানের কাছাকাছি। ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার’ নিশ্চিত করে কূটনীতিকরা যৌথ বিবৃতির খসড়া তৈরি করে যারা বিশ্বাস করে যে ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ করছে।
ইইউর সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যুদ্ধবিরতির সমর্থনের দিকে অগ্রসর হলেও শীর্ষ সম্মেলন কোনো যৌথ বিবৃতিতে একমত হতে ব্যর্থ হয় এবং জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে একটি গভীরভাবে বিভক্ত ইউরোপীয় সংসদ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে। তবে এটি ‘হামাসকে ভেঙে দেয়ার’ শর্ত দেয়- এভাবে কার্যত অব্যাহত ইসরাইলি আক্রমণকে বৈধতা দেয়া হয়। ততক্ষণে গাজায় মৃতের সংখ্যা ২৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, ছিটমহলের বেশির ভাগ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ২০ লাখ মানুষ অনাহার ও রোগের মুখোমুখি হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
এমন কঠিন সময়ে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য- তাদের অস্ত্র রফতানি নীতি সত্ত্বেও ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখে। ইউরোপ ইসরাইলের আক্রমণকে সংযত করার চেয়ে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত করেছে। সরকারের এই অবস্থান জনমতকে প্রতিফলিত করে না। জানুয়ারির এক জরিপে ৬১ শতাংশ জার্মান মনে করেন, গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান ন্যায়সঙ্গত নয়।
এই সঙ্কট ইইউর প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বকেও বিভক্ত করেছে। ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লিয়েন, একজন জার্মান খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাট, ইসরাইল-জোটবদ্ধ পদ্ধতির মূর্ত প্রতীক। তিনি ৭ অক্টোবরের পরের দিনগুলোতে, কমিশনের সদর দফতরে ইসরাইলি পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, এর আগে ইউক্রেনের জন্য করা হয়েছিল। তিনি ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ ওপর জোর দেয়ার বড় মাউথপিস, সমর্থন জানাতে ইসরাইল সফর করেছিলেন, গাজায় যাননি এবং কোনো মুসলিম নেতার সাথে কথাও বলেননি। এই হলো ইউরোপের মধ্যমণির রাজনৈতিক শিষ্টাচার! ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি হিসেবে তিনি বারবার ইসরাইলের প্রশংসা করেছেন।
উরসুলার সফরের সময় গাজায় ইসরাইলের নিষিদ্ধ বোমা হামলায় প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। এমনকি অক্টোবরে উরসুলার নেতৃত্বে কমিশনের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে ‘ইসরাইলের জন্য ইইউর পূর্ণ এবং দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়’ লিপিবদ্ধ করা হয়। নেতানিয়াহুর হাত সাফাইয়ে পরিতৃপ্ত উরসুলার বিপরীতে, ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল, যিনি একজন বেলজিয়ান উদারপন্থী এবং ইইউর পররাষ্ট্রবিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি, জোসেপ বোরেল, যিনি একজন স্প্যানিশ সমাজতান্ত্রিক, ইইউকে আরো মধ্যপন্থী দিকে চালিত করার আহ্বান জানান ও চেষ্টা করেন।
বোরেল প্রায়ই অন্যান্য আন্তর্জাতিক নেতার তুলনায় সঙ্ঘাতের বাস্তবতা সম্পর্কে আরো খোলামেলা কথা বলেন। হামাসের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি তিনি এই সঙ্কটকে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ৩০ বছর ধরে চলা রাজনৈতিক ও নৈতিক ব্যর্থতার পরিণতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে বাস্তবে পরিণত করা কথাও তিনি বলেছেন। বোরেল বলেন, ‘আজ রাতে আমাকে ডিনার দেয়ার কোনো অর্থ নেই, যদি আপনি আগামীকাল আমাকে হত্যা করেন।’
এ দিকে জাতিসঙ্ঘে গাজায় নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হয়। নিরাপত্তা পরিষদে সবাই ভোট দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভোটে অংশ নেয়নি। নেতানিয়াহু ভেটো না দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। ইসরাইলকে শান্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন অস্ত্র পাঠিয়েছে। নতুন অস্ত্র প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে এক হাজার ৮০০ এমকে-৮৪ দুই হাজার পাউন্ড বোমা, ৫০০ এমকে-৮২ ৫০০ পাউন্ড বোমা, ২৫টি এফ-৩৫ এস যুদ্ধবিমান। কী ভয়াবহ দ্বিচারিতা! ওয়াশিংটন ইসরাইলকে বছরে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামারিক সহায়তা দিয়ে থাকে। গাজা সঙ্কট আব্রাহাম চুক্তির অধীনে মার্কিন মধ্যস্থতায় শান্তি প্রক্রিয়াকেও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। চীন ও রাশিয়া এ থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেমনটি বহু দেশ ব্রিকসে ফিরে এসেছে এবং নিজেকে একটি ভূ-রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে চালু করেছে। ৩৪টি দেশ প্রধান উদীয়মান অর্থনীতির ব্লকে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ব্রিকসকে ক্রমবর্ধমানভাবে পশ্চিমা আধিপত্যের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব স্বার্থপর রীতিনীতির জন্য আস্তে আস্তে একঘরে হয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমারা গাজায় তেলআবিবের আগ্রাসনের প্রতি অবিচল সমর্থন দেখিয়ে, ‘আত্মরক্ষার’ এবং হামাসকে পরাজিত করার অধিকারকে সমর্থন করেছে। কিন্তু এখন, ২ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধের ১৭৬ দিন অতিবাহিত হলেও কাক্সিক্ষত জয় হয়নি; বরং একটি গ্লানিকর পরাজয় তাদের তাড়িত করছে। গাজায় রক্তপাত বন্ধ ও যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের আহ্বান বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে, পশ্চিমা শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক মঞ্চে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। হতাশা কী চরমে উঠেছে তা বোরেল ছাড়াও মার্কিন এক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যানের কণ্ঠেও শোনা যায়। গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন এই মার্কিন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ওয়ালবার্গ। তিনি বলেন, গাজায় মানবিক সহায়তার জন্য একটি পয়সাও ব্যয় করা উচিত নয়। যুদ্ধজয় ও যুদ্ধ শেষ করার জন্য পারমাণবিক বোমা দরকার।
প্রায় সব ইইউ দেশ ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়েছে, তবে স্পেন, বেলজিয়াম ও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলো ইসরাইলের প্রতিক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও জার্মানির মতো অন্যরা ইসরাইলের নিন্দা করার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল- প্রাগ ও বুদাপেস্টও দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি পদক্ষেপকে আটকে দিয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি তাদের চূড়ান্ত অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেছেন, ইসরাইল ‘একটি গণতান্ত্রিক দেশ’ হওয়ায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে সে বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। অন্য দিকে অস্ট্রিয়ার নেতা কার্ল নেহামার একই ধরনের মনোভাবের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, ‘যুদ্ধবিরতি ও শত্রুতা বন্ধের সব কল্পনা হামাসকে আরো শক্তিশালী করেছে।’ ইসরাইলের সমালোচনা করতে তাদের অবস্থান ও অনীহা বাকি বিশ্বের সাথে চরম বিরোধপূর্ণ। অন্য দিকে লাতিন আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ গাজায় ইসরাইলের চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বলিভিয়া, চিলি ও কলম্বিয়াসহ লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ হয় সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অথবা তাদের রাষ্ট্রদূতদের ফিরিয়ে নিয়েছে। মালয়েশিয়া, বলিভিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ব্রাজিলের মতো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য গ্লোবাল সাউথ দেশগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার পক্ষে তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে। গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশ ফিলিস্তিনিদের কারণকে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে ডিকলোনিয়াল সংগ্রাম হিসেবে দেখে।
২২ মার্চ স্পেন জানায়, মধ্যপ্রাচ্য শান্তির জন্য তারা ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ঘোষিত রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রথম পদক্ষেপ নিতে আয়ারল্যান্ড, মাল্টা ও স্লোভেনিয়ার সাথে একমত হয়েছে। ইসরাইল এই চারটি দেশকে বলেছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য তাদের পরিকল্পনা ‘সন্ত্রাসবাদের পুরস্কার’।
গাজা যুদ্ধ ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউ। অনেকেই যুক্তি দেখান, ইইউর দৃষ্টিভঙ্গিতে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈত মান রয়েছে। ইইউ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও নিষ্পত্তিমূলক কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে। সমালোচকরা যুক্তি দেন, বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বন্দ্ব মোকাবেলা করার সময় ইইউ বিভিন্ন মান প্রয়োগ করে। অভিযোগ রয়েছে, গাজা যুদ্ধে ইইউর প্রতিক্রিয়া ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের মতো অন্যান্য সঙ্ঘাতের বিষয়ে তাদের অবস্থান থেকে আলাদা। ইইউ আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করে, তবে বাস্তবায়নের দিকে কোনো অগ্রগতি নেই। মার্চের শেষ সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ‘দ্বৈতনীতি’ পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন। সূত্র নয়া দিগন্ত