• রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম:

উচ্চশিক্ষার আর্থিক ও নীতিগত বিশ্লেষণ

আপডেটঃ : রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৭

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পদ্ধতিগত পরিবর্তন এবং প্রযুক্তিগত পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা প্রশংসিত হচ্ছে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও। তবে স্বল্প সময়ে প্রযুক্তিগত পদ্ধতির পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা খুব সহজ কাজ নয়।

বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় পরোক্ষ একটি আর্থিক ক্ষতি লক্ষ্যণীয়। আর তা হলো, প্রকৃত মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রা ও শিক্ষাগ্রহণ শেষে নিজ দেশে ফিরে না আসা। এটি বাংলাদেশের মোটামুটি সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিগত কয়েক দশকে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রার জন্য অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছি আমরা। বিদেশে মেধাপাচারের এই ক্ষতি বহুমাত্রিক। এটাকে আমরা মেধাপাচার বলছি এজন্য যে, এ সকল শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই আর দেশে ফিরে আসছে না। তারা তাদের মেধা কাজে লাগাচ্ছে সেই দেশের কল্যাণে, যেই দেশ থেকে তারা উচ্চশিক্ষা লাভ করছে। তিন বছর আগে ইউনেসকো পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও কানাডাতে পড়তে যাওয়া প্রায় পনেরো হাজার শিক্ষার্থীর গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কোর্স সম্পন্ন করতে ৬ বছরে খরচ হবে প্রায় ১৯২ বিলিয়ন টাকা।

বর্তমান সরকারের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক পলিসি বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)’র অবদান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসের যেকোনো সময়ের বিবেচনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতসহ শিক্ষকদের জন্য গবেষণা ফান্ড থাকা ও তদানুযায়ী গবেষণা করা বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে ইউজিসি’র বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার এই উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসি’র এই নির্দেশনা মোতাবেক শিক্ষাকার্যক্রম গ্রহণ করতে অনেকটাই অনীহা দেখিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ কারণে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটাই পিছিয়ে। সম্প্রতি বিশ্বের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েব মেট্রিকস গত জুলাই মাসে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ১৫০টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপের ভিত্তিতে ২০০০-এর ভিতরে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে এদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। জরিপে বিবেচনা করা হয়েছে শিক্ষাপদ্ধতি, গবেষণার প্রভাব, শিল্পের প্রযুক্তি হস্তান্তর, অর্থনৈতিক লেনদেন ও গবেষণা ইত্যাদি। স্পেনের জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল সাইবার মেট্রিকস ল্যাব এই রিপোর্টটি তৈরি করে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থান যথাক্রমে ২০৩৪ নম্বরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ২০৬১ নম্বরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ২২৭৫ নম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শীর্ষে আছে হাভার্ড (আমেরিকা) বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রণীত পলিসি নির্দেশনা ও সম্পদের বণ্টনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা ও গবেষণাকর্মে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্পেনের গবেষণা কাউন্সিলটির আরেকটি নির্ধারক ছিল অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বিশেষ করে অর্থনৈতিক লেনদেন ও অর্থনৈতিক বিষয়ে গবেষণা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। কেননা আগামীতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বা বাজার বা বাণিজ্য বিষয়ক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থনীতি বিভাগগুলো গবেষণা সেল চালু করে প্রত্যেকটি বিভাগের শিক্ষকদের অথনীতি বিষয়ক সংলাপে আত্মনিয়োগ করাতে পারে। এতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে বিষয়গুলোর সঙ্গে অর্থনীতির আন্তর্সম্পর্ক বিষয়ক শিক্ষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতটি হলো আমাদের গার্মেন্টস শিল্প। মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৫৬ শতাংশ অর্জিত হয় গার্মেন্টস শিল্প হতে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই শিল্পের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যে সকল টেকনিশিয়ান রয়েছে তারা বাংলাদেশি নন। কেননা, বাংলাদেশে সেই ধরনের টেকনিশিয়ানের দারুণ অভাব, যারা এই জ্ঞানে বিদেশিদের থেকে পিছিয়ে। এ কারণে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর গার্মেন্টস শিল্পের এসব বিদেশি টেকনিশিয়ানরা বাংলাদেশ থেকে তাদের বেতন বাবদ ৬ বিলিয়ন টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই ধরনের টেকনিশিয়ানের অভাবের অন্যতম কারণ হলো, আমাদের দেশে ফ্যাশনবিষয়ক শিক্ষার ওপর উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ একেবারেই অপ্রতুল। আমাদের দেশে নামকরা কোনো ফ্যাশন ইউনিভার্সিটি নেই, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা ফ্যাশনবিষয়ক জ্ঞান লাভের মাধ্যমে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে প্রধান টেকনিশিয়ানের ভূমিকায় থেকে এই খাতকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাবে। আমাদের যথোচিত উদ্যোগ ও উপলব্ধির অভাবে এত বড় অঙ্কের টাকা আমরা বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে পারি না।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে পলিসি প্রক্রিয়ায় কয়েকটি বিষয়ে মনোনিবেশ করা জরুরি। মেধাপাচার রোধে আমরা একটি বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে Foreign Collaboration Approach গ্রহণ করতে পারি। ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং কানাডার ৫/১০টি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে Franchise Collaboration করে আমরা আমাদের মেধা ও অর্থ দুটোই কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারি। উচ্চশিক্ষার গবেষণার বিশ্বমান বজায় রাখতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত অধ্যাপকদের ভিজিটিং অথবা ফুল টাইমার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিষয়ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সেমিনার বছরে দুইবার আয়োজন করার উদ্যোগ গৃহীত হতে পারে। সেক্টর ভিত্তিক টেকনিশিয়ান তৈরির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে।

বর্তমানে বিশ্বব্যবস্থায় চলছে উচ্চশিক্ষার উদারিকরণ ও বাজারিকরণ। এক্ষেত্রে শিক্ষা হতে হবে সার্বজনীন ও জব ওরিয়েন্টেড। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা এই প্রক্রিয়ার বাইরে অবস্থান করতে পারি না। শুধু পলিসি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন নয়, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের কর্মপরিসরে পরিবর্তন আনয়ন এখন আশু প্রয়োজন।

n লেখক :সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিম)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ