• রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৮ অপরাহ্ন

বিজয়ী হওয়ার সহজ পথ কি জবরদস্তি?

আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আগেও মারামারি করেছেন। এখনো করছেন। সর্বশেষ গত ২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলের সভায় মারামারি-হাতাহাতি হয়েছে। সহকর্মীদের আঘাতে একজন শিক্ষক আহতও হয়েছেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ খ ম জামাল উদ্দীন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সমর্থক। তিনি বলেছেন, প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী ও তাদের পক্ষের আরও দুই শিক্ষক এই হামলা করেছেন, আঘাতে নাক দিয়ে রক্ত ঝরেছে তার। জামাল উদ্দীন বলেছেন, ‘বক্তব্যে প্রক্টর আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছিল। এ সময় আমি তাকে বলি, আপনি একজন প্রক্টর হিসেবে আমাকে এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে পারেন না। তখন তিনি আমাকে আঘাত করেন। এরপর শাহ মাসুম এবং সীতেশ চন্দ্র বাছার আমাকে কিলঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। মাসুম চেয়ার নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে। তখন উপস্থিত নীল দলের অন্য শিক্ষকরা আমাকে ঘিরে বলয় তৈরি করে রক্ষা করেন। ঘুষির ফলে আমার নাক দিয়ে রক্ত ঝরা শুরু হয়।’

 

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বিকেল চারটায় শুরু হওয়া এই সভায় প্রথম থেকেই সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকপন্থি এবং বর্তমান উপাচার্য আখতারুজ্জামানপন্থি শিক্ষকরা একপক্ষ আরেকপক্ষকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিতে থাকেন। জামাল উদ্দীন বক্তব্যে সাবেক উপাচার্য সম্পর্কে তার আগের বক্তাদের কটাক্ষমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। তার পরে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রক্টর গোলাম রব্বানী ফের আরেফিন সিদ্দিক ও জামাল উদ্দীনকে নিয়ে কথা বললে জামাল উদ্দীন তার প্রতিবাদ করেন। তখন তাদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ধরনের মারামারি-হাতাহাতি-গালাগালির ঘটনা আমাদের সমাজে এখন প্রায়ই ঘটছে। গালাগালি, মারামারিতে সবাই সিদ্ধহস্ত, সবাই নিয়মিত এর চর্চাও করছে।

 

পথে-ঘাটে, বাস-রেলগাড়ির কামরা বা গ্রামের বিদ্যালয় থেকে কলেজ ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, থানায়-অফিসে সর্বত্র এখন মধুবর্ষণ। ‘শালা’ আজ আমাদের ভাষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ‘ইয়ে’, ‘মানে’, ‘বাপ রে’, ‘মা গো’ ইত্যাদি যে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহূত হয়, ‘শালা’ও তাই। শিশু তো শুনে শেখে, সে শোনার মধ্যে শুধু ‘মা’ ডাকটাই তো নেই, যা শুনলে একদা ‘ভদ্র’ বাঙালি কানে আঙুল দিত সে রকম অজস্র শব্দ অহরহ তার কানে ঝংকৃত হচ্ছে। সে শিখছে।

 

সুহূদ ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই এই অকথা-কুকথার ধারা-প্রবাহকে বঙ্গসংস্কৃতির রসাতল গমন মনে করেন। আবার কেউ কেউ একে একটা ইতিবাচক সমাজ পরিবর্তনের লক্ষণ মনে করেন। প্রথম অংশটি নগরবাসী, কিংবা নাগরিক প্রভাবাচ্ছন্ন। এদের কথাগুলো অক্ষমের নিষ্ফল ক্রন্দন। দীর্ঘকাল সুখে দিন কাটানোর পর, অকস্মাত্ ক্ষমতাবৃত্ত থেকে ছিটকে পড়া এই বাগ্?জীবী শ্রেণিটি দিশেহারা। সব দোষ গিয়ে পড়ছে শাসকশ্রেণির উপর। ক্ষমতার অপব্যবহারকে দ্রুত অভ্যাসে পরিণত করে আমাদের শাসকচক্র দলীয় রাজনীতিকে একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান করে তুলেছেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উন্নততর করার জরুরি কর্তব্যটা আজ হারিয়ে গেছে। যেখানে প্রধান কাজটা ছিল লোক-সমুদয়কে সম্মানের সমতায় রাজনীতির বৃত্তে নিয়ে আসা, সেখানে কাজটা হয়ে দাঁড়াল অভিভাবকত্ব। জনগণ নাবালক, তারা নিজের ভালোমন্দ বোঝে না, সুতরাং পার্টি নামক অগ্রণী বাহিনীকে সেই দায়িত্বটা নিতে হবে। এই বোধ থেকেই বোধহয় জন্ম নিয়েছিল একটা অনুজ্ঞা: জনগণকে সহজ ভাষায় বোঝাতে হবে।

 

এখানে একটা মস্ত সমস্যা তৈরি হলো। প্রথম, সামুদায়িক রাজনীতির মতো একটা জটিল ব্যাপারকে সহজভাবে বোঝানো সহজ নয়, সে ভাষা আয়ত্ত করতে নিরবচ্ছিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিগত অনুশীলন দরকার হয়, এবং সে অনুশীলনটাকে হতে হয় ব্যাপক আদান-প্রদানভিত্তিক, যাতে সমাজের নানা পক্ষ, দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করে উঠতে পারেন। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাজনীতির প্রত্যক্ষ কর্মীদের যেমন জনগণের ভাষা বুঝতে শিখতে হবে, তেমনি চাষি-মজুর-ব্যাপারী-ছাত্র-গৃহবধূদেরও রাজনীতির ভাষায় সড়গড় হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করাটাকে অবশ্যকর্তব্য মানতে হবে। কিন্তু ক্ষমতার তুলনামূলক নিশ্চয়তা যেহেতু গণসম্পর্কের বদলে একটা প্রজাসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে দিল, অচিরে একপ্রকার আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা সামাজিক-রাজনৈতিক ভাষাচর্চার সম্ভাবনাকে অবলুপ্ত করল। ফলে সমাজ তার মতো করে রাজনীতির সঙ্গে আপস করে নিজের ভাষা গড়ে তুলল। খেয়াল করলেই দেখা যায়, সাংস্কৃতিক মানের অবনতির চিহ্ন হিসেবে যে ভাষা-ব্যবহারকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে, সে ভাষা কিন্তু ক্ষমতারই ভাষা। আধার হিসেবে এ ভাষা বেছে নিয়েছে সহজতম, প্রাচীনতম এক নিপীড়নকে—নারীর উপর পুরুষের অত্যাচার।

 

বাংলার শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আমরা সংগত কারণেই গর্ব করে থাকি। সেই চর্চাতেও কিন্তু এই যুক্তিবিচ্ছিন্নতার প্রভাব স্পষ্ট। জনগণের ভাষায়: কথা বলার এমন বহু নমুনা আছে, যেগুলো স্পষ্টত লিঙ্গ-বিদ্বেষ, বা অন্য প্রকার সামাজিক বিভেদকে মহিমান্বিত করে চললেও নিন্দিত না হয়ে জয়ধ্বনি পেয়ে এসেছে। মাতা বা ভগিনীদের সঙ্গে বলাত্কারী সম্ভোগেচ্ছার দাম্ভিক ঘোষণার সূচক গালাগালিগুলো মহানগরের নাট্যমঞ্চে, কবিতা-উপন্যাসে ‘সমাজ-বাস্তবতা’র অভিজ্ঞান হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে এসেছে। প্রশ্ন ওঠেনি, এ বাস্তবতাকে উদযাপন বা উপভোগ করব, না পরিবর্তন করার জন্য উদ্যোগী হবো। এখানেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক রাজনীতির পরিপূরক হলো বিচ্ছিন্নতা। ফলিত রাজনীতির লোকসমাজের ওপর কর্তৃত্ব সামাজিক সংস্কৃতিকেও আত্মবঞ্চিত করেছে ।

 

স্বাভাবিক রাজনৈতিক বোধে শাসকশ্রেণি রাজনীতি ও সমাজের মধ্যবর্তী এই সংলাপের ফাঁকটিকে সহজেই ধরতে পেরেছেন, এবং নিজের রাজনৈতিক পরিচিতিটাকে সামাজিক ছাঁচের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন যাতে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বার্তাটি নগরায়িত সাংস্কৃতিক বৃত্তের বাইরে থাকা তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকদের কাছে নির্ভুলভাবে পৌঁছে যায়। যে বাক্-ব্যবহারের কারণে তিনি নগর-সভ্যদের কাছে ধিকৃত হন, সেই ‘স্পষ্টকথন’ তার জন্য গ্রাম-বাংলার আনাচ-কানাচ থেকে বিপুল সংবর্ধনা সংগ্রহ করে আনে। তিনি জানেন এটাই ‘সমাজবাস্তবতা’। লোকে এই ভাষা বোঝে, এই ভাষায় কথায় বলে, আর তাই, তার দৃশ্য রূপায়িত ‘বাঁশ দেওয়া’ মুহুর্মুহু করতালিতে বাংলার রেনেসাঁস নান্দনিকতাকে কলা দেখিয়ে আপনবেগে বইতে থাকে। তিনি যে সহজিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাহক, সামাজিক সংস্কৃতির অপরিশীলিত রূপটা তার চমত্কার পরিপূরক।

 

রাজনীতি ও সমাজের সমীকরণ ঘটানোর কাজটি দুরূহ। বাংলাদেশে এটা আরও কঠিন। এখানে দলের মাদল না বাজালে বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত শান্তি পান না। সবাই যেন দলবাজ। সবাই যেন সবার প্রতিপক্ষ। প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, কেবল শত্রুতা। এর অনিবার্য ফসল মারামারি, গালাগালি। নোংরামি। পারস্পরিক সদ্ভাব, একে-অপরের প্রতি সহজ, স্বাভাবিক, সম্মাননির্ভর সম্পর্ক স্থাপনের কাজটা একান্ত জরুরি। কিন্তু, কঠিন রাস্তায় যাওয়ার ভবিষ্যদৃষ্টি যে রাজনীতি দেখাতে পারে, আমাদের রাজনীতি তার অনুশীলনে অভ্যস্ত নয়। ক্ষমতালোভীদের সমস্যা হলো অতীত বা ভবিষ্যতের সঙ্গে তার ভাবনার বড় একটা যোগ নেই, সে বর্তমানে বাঁচে, কিন্তু বর্তমানেই যে তার প্রয়াণও নিশ্চিত হতে থাকে, সেটা তার মনোজগতে ধরা পড়ে না। পড়লে সমাজে সম্মানিত হিসেবে পরিচিত একইসঙ্গে গালিবাজ-ঝগড়াবাজরা দেখতে পেতেন, কীভাবে তাদের ‘উদ্ভাবিত’ সহজিয়া পথটা এমন কারো দখলে চলে যাচ্ছে, যে নাকি এ পথ ব্যবহারে তার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ, কেননা এ পথটাই তার একমাত্র পথ। যুক্তিহীনতা, মতান্ধতা, জবরদস্তির মতো সহজতম পথেই যে আমরা বিজয়ী হতে চাইছি! অশালীনতাকেই জীবনের একমাত্র সাফল্যের চাবি হিসেবে মেনে নিয়েছি।

 

সময়ের কিছু দাবি থাকে, মানবসভ্যতার কিছু চাহিদা থাকে। এখনকার চাহিদাই বুঝি এরকম! বিশ্বদ্যািলয়ের শিক্ষকরা মারামারি করবে, একে অপরের নাক ভেঙে দেবে—এটাকেই মেনে নিতে হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ