• শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২০ অপরাহ্ন

পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে কেন?

আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

‘পরীক্ষা কেন্দ্রের বদলে স্বামীর ঘরে।’ ৯ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, শিবগঞ্জ (বগুড়া) ও তারাগঞ্জের (রংপুর) ১০০ ছাত্রী বাল্যবিবাহের কারণে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। পরের দিনের খবরে জানা যায়, বাল্যবিবাহের কারণে পাথরঘাটায় ৪৫ ছাত্রী জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় বসছে না। আবার ১৪ নভেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে:‘অনুপস্থিত ছাত্রীদের অধিকাংশ বাল্যবিবাহের শিকার।’ যার মধ্যে ৪০ জন ছাত্রীই একটি (গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী) উপজেলার। যারা জেডিসি বা জেএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের বয়স ১৩/১৪’র বেশি নয়, এদের কেন পরীক্ষার হলে না গিয়ে স্বামীর ঘরে যেতে হচ্ছে? সে বিষয়টি নিয়েই মূলত আজকের লেখা।

 

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা হিসেবে মাঠ প্রশাসনে (উপজেলা, জেলা, বিভাগ) চাকরি করার সুবাদে দেখেছি, কীভাবে গ্রাম এলাকায় গোপনে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। কোনো উপজেলায় বা জেলায় বাল্যবিবাহ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বা জেলায় গিয়ে বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করা হচ্ছে। এসব বাল্যবিবাহের যে কারণগুলো জানা যায়, তার মধ্যে দারিদ্র্য, নিরাপত্তার অভাব, ইভটিজিং, চর-হাওর ও পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব ও পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবাসন সুবিধা না থাকা, ছেলে সন্তানের প্রতি নির্ভরশীলতা, কুসংস্কার, অভিভাবকের সচেতনতার অভাব, যাতায়াতের সমস্যা, পিতা-মাতার নিরক্ষরতা, যৌতুক প্রথা প্রভৃতি অন্যতম।

 

বাল্যবিবাহের কুফল থেকে রক্ষার জন্য প্রণীত আইন—বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুসারে বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলেদের ২১ বছর এবং মেয়েদের ১৮ বছর হওয়া বাধ্যতামূলক। নতুন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর ৭(১) ধারায় অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে বিয়ে করলে তজ্জন্য শাস্তি অনধিক ২ (দুই) বত্সর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন, ৭(২) ধারায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউ বিবাহ করলে তার অনধিক ১ মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা জরিমানা করার, ৮ ধারায় পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, আইনগতভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করলে বা অনুমতি বা নির্দেশ দিলে ২ (দুই) বত্সর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। আইনের ১১ ধারায় বিবাহ নিবন্ধক বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করলে তার জন্য অনধিক ২ (দুই) বত্সর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বা উভয় দণ্ডের বিধান করা হয়েছে।

 

হাওর জেলা নেত্রকোনায় চাকরি করার সময়ে দেখেছি বিদ্যালয়গুলো অনেক দূরে অবস্থিত। চর এলাকা বরিশালেও দেখেছি একই অবস্থা। এমনকি যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো নয়। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায় কর্মশালা করতে গিয়ে জানতে পেরেছি, পাহাড়ি এলাকায়ও বিদ্যালয়গুলোর দূরত্ব অনেক বেশি—প্রতিদিন গিয়ে ক্লাস করা সম্ভব নয়। উল্লিখিত এলাকাগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে এবং যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন করা যেতে পারে। পাহাড়ি এলাকায় ইতোমধ্যেই বিদ্যালয়ের সাথে হোস্টেল নির্মাণ শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার প্রতি আরও আগ্রহী হবে এবং বাল্যবিবাহ কমে যাবে।

 

শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০১৭ সালে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে ১ কোটি ৬৬ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৭ জন শিক্ষার্থীকে মোট ২ হাজার ৪৬৬ কোটি ৪৬ লাখ ১ হাজার একশ’ আটাশ টাকা বৃত্তি ও উপবৃত্তি বাবদ প্রদান করা হয়েছে। এতে নারী শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এ উদ্যোগের পাশাপাশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রকল্পের আওতায় এনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার অনেক কমে আসবে।

 

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক স্কুলছাত্রীর বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিল একই স্কুলের সাত ছাত্রী। তাদের সংগঠনের নাম ‘ঘাসফুল’। এভাবে সারাদেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে দেওয়া হলে তারাই বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা করতে পারবে শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও শিক্ষার্থীদের কাছে থাকলে, কর্মকর্তারা জানতে পারলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে।

 

বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের হার শূন্যের কোঠায়, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫-১৮ বছরের বাল্যবিবাহের হারকে এক-তৃতীয়াংশে ও ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছে। প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ বাতিল করে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ প্রণয়ন করেছে। এ আইনের ব্যাপক প্রচার ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হলে বাল্যবিবাহ রোধ হবে বলে আশা করা যায়। ইতোমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করায় ইভটিজিং-এর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। সরকার কঠোর আইন করায় এসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে গেছে। শিশু অপহরণ ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি এবং কঠোর শাস্তি প্রদান করা হলে এ জাতীয় অপরাধ কমে যাবে এবং নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা থেকে অভিভাবকেরা মুক্তি পাবে। কোনো ছাত্রীকেই পরীক্ষা কেন্দ্রের বদলে যেতে হবে না স্বামীর ঘরে।

 

লেখক:ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব),


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ