দীর্ঘদিন ধরে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে বাংলাদেশ। তবে দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলে মার্কিন অংশীদারদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার দিকে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ জোটের লক্ষ্য চীনকে ঠেকানো বা মোকাবিলা। গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক সাময়িকী ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব বিষয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ গত মাসে তার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকের একটি খসড়া চূড়ান্ত করে। খসড়ায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি মুক্ত, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ অঞ্চলের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পদক্ষেপ ঢাকা এমন সময় নিল, যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং কয়েকটি মার্কিন প্রধান প্রধান মিত্র ইঙ্গিত দিয়েছে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হওয়া উচিত বাংলাদেশেরও। গত সপ্তাহে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা নয়াদিল্লিতে একটি বক্তৃতা দেন। তার বক্তৃতাকে এই অঞ্চলের জন্য একটি ‘নতুন পরিকল্পনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। বক্তব্যে কিশিদা নতুন অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তিসহ বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া চলতি মাসেই যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক মন্ত্রী অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান বাংলাদেশ সফর করেন।
ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হতে বলছে এই দেশগুলো, তা বোঝা বেশ সহজ। বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়া ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কোয়াডভুক্ত দেশ এবং ইউরোপের অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। এ দুই বাস্তবতায় বাংলাদেশ সবার কাছেই ভালো অংশীদার।
অন্যদিকে, চীন অবকাঠামোগত ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশে তার নিজস্ব প্রভাব বাড়িয়েছে। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে চীনের এই ঋণকে খারাপ চুক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া ভারত মহাসাগর অঞ্চলের পশ্চিমের জিবুতিতে চীনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। যা নিয়ে দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বীরা উদ্বিগ্ন। মূলত এসবই বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকায় অবস্থিত। এ ছাড়া চীন বাংলাদেশের অস্ত্রের বড় সরবরাহকারী। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনে বাংলাদেশের যোগদান হবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কৌশলগত বিজয়।
তবে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কেন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হতে চাইবে, যার লক্ষ্য চীনকে মোকাবিলা। যেখানে বাংলাদেশের লক্ষ্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা কখনোই পররাষ্ট্র নীতিতে নিরপেক্ষতার নীতি থেকে বিচ্যুত হননি। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিও জোট নিরপেক্ষ। তবে দেশটি চীনকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে ওয়াশিংটনের প্রধান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদার হওয়ার কাছাকাছি নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সরকার বেশ ঘনিষ্ঠ এবং নয়াদিল্লি সম্ভবত ঢাকাকে এই কৌশলটি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছে। দুই বছর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্কের অংশ হতে ইচ্ছুক’ এবং ভারত ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।’
এমনকি বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে গ্রহণ করলেও একই সঙ্গে চীনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ঢাকার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে চায় এবং ঢাকার কোনো নিরাপত্তা লক্ষ্য নেই। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক খসড়াকে ‘নীতি’ বা ‘কৌশল’ না বলে এটিকে একটি আউটলুক বা ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ বলার একটি নরম অর্থ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এমন ইঙ্গিত এখনো দেয়নি যে, দেশটি চারদেশীয় জোট কোয়াডে যোগ দেবে। এরপরও চীনকে উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ঢাকাকে মার্কিন শিবিরে টেনে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তোলেন। আর তাই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে সরে আসতে পারে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যদি অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বলে বিবেচিত হয়, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলোও এই সম্পর্ক পিছিয়ে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক এই সাময়িকীটি বলছে, কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ সরকার জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে একটি নতুন সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থানের বিষয়ে সতর্ক করেছে। গত বছরের অক্টোবরে এই জঙ্গি সংগঠনের কথিত ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ ছাড়া র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। কারণ, এই বাহিনী নতুন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০২১ সালের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের প্রচেষ্টার সফলতা দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় আগ্রহ রয়েছে, তবে একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী এই বার্তাও পাঠাতে চায় যে, ওয়াশিংটন বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে উদ্বিগ্ন।