• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১২ অপরাহ্ন

পানির সংকটে আগুন নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জে ঢাকা,

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৩

চার বছর আগে রাজধানীর চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে পানির সংকটে নিয়ন্ত্রণে আসছিল না আগুন, ৭১ জন মানুষ পুড়ে হয়েছিল কয়লা। মঙ্গলবার বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে আবারও ফুটে উঠল তীব্র পানি সংকটের মর্মান্তিক চিত্র। আশপাশে নেই এমন কোনো পুকুর বা খাল, যেখান থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে পারে ফায়ার সার্ভিস। অবশেষে হেলিকপ্টারে দড়ি বেঁধে হাতির ঝিল থেকে পানি নিয়ে ছিটানো হয়েছে অগ্নিকুণ্ডে। সারা দেশে একের পর এক ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। রাজধানীতে অধিকাংশ সময় পানিস্বল্পতার কারণে আগুন নেভাতে সমস্যায় পড়ছেন ফায়ার ফাইটাররা। সরু রাস্তায় পানি বহনকারী গাড়ি প্রবেশ করতে বাধছে বিপত্তি। ভরাটের দৌরাত্ম্যে উধাও হয়ে গেছে রাজধানীর খাল, পুকুর, জলাশয়। নগরীর রাস্তা, কারখানা, হোটেল, অধিকাংশ শপিং মলে নেই ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা। এতে আগুনে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়।

১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ৩৮ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি পুকুর ও জলাধার। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) এক সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গত সাড়ে তিন দশকে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল। জলাশয় ভরাটের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর এবং নিম্নভূমি ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর।

একই সময়ে খাল ও নদী ছিল ২ হাজার ৯০০ হেক্টর। রাজধানীর বৃষ্টির পানি এসব খাল দিয়েই পড়েছে নদীতে। ২০১৪ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ হেক্টরে, নিম্নভূমি ৬ হাজার ১৯৮ হেক্টরে এবং নদী-খাল ১ হাজার ২ হেক্টরে। অর্থাৎ জলাশয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ সময়ের ব্যবধানে নিম্নভূমি কমেছে ৫৪.১৮ এবং নদী-খাল ৬৫.৪৫ শতাংশ। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যানমতে, ১৯৮৫ সালের দিকে ঢাকায় মোট পুকুর ছিল ২ হাজার। বেসরকারি হিসাবমতে, এ বছর পর্যন্ত তা এসে ঠেকেছে ১০০-তে, যদিও ঢাকায় পুকুরের প্রকৃত সংখ্যার হিসাব নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে ১ হাজারের বেশি পুকুর ছিল রাজধানীজুড়ে।

এখন খুঁজলে শখানেক পুকুরও মিলবে না। উন্নয়নের নামে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। বিপদ এলে এ ক্ষতগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আগুন লাগলে পুকুর, জলাধার না থাকায় পানি মিলছে না। জলাধার রক্ষায় ২০০০ সালে আলাদা আইন করলেও এর কোনো সুফল মিলছে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অধিকাংশ এলাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা। যেখানে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে ওঠে সেখানে ফায়ার হাইড্রেন্টের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো রাখা হয় না বা মানা হয় না। কর্তৃপক্ষ চাইলে এর ব্যবস্থা করা জটিল কিছু নয়। নগরে যে মানুষগুলো থাকে, তাদের নিরাপত্তা দেওয়াটা জরুরি।’

নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি পরিকল্পিত নগরীতে আগুন নেভানোর জন্য বিভিন্ন রাস্তার ধারে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ বসানো থাকে, যা সরাসরি পানির পাম্পের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া থাকে এবং এতে পানির অতিরিক্ত প্রেশার দেওয়া থাকে। কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে পৌঁছামাত্রই হাইড্রেন্টের বাল্ব খুলে পানি ছিটানোর জন্য পাইপ লাগাবেন; আর সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গতিতে পানি বেরিয়ে আসবে, যা দিয়ে সহজে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

চারপাশে নদীবেষ্টিত ঢাকা শহরে পানির অভাবে আগুন নেভাতে না পারার মতো ঘটনাকে লজ্জাজনক বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। আগুন লাগলেই ওই এলাকায় ভিড় জমাচ্ছে উৎসুক জনতা। ভিড় ঠেলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অনেক সময় পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হচ্ছে। গুলশান-২-এর বহুতল ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে উৎসুক জনতার কারণে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছিল ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ করেও ভিড় সরাতে পারেনি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রধান বাধা ছিল উৎসুক জনতা। পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।’

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড দেখা, ভিড়িও ধারণ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করতে গিয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন অনেকে। আগুন লাগার পর উৎসুক মানুষকে সরাতে পুলিশ ধাওয়া দিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। অলিউর রহমান নয়ন নামে এক কিশোরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা লাইভ করা হয়েছিল। পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মরদেহ শনাক্ত করেন স্বজনরা। কিন্তু এর পরও টনক নড়েনি। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে অতিউৎসাহী মানুষের ভিড়ে পানির পাইপ টানা, দৌড়ে কাজ করতে ভীষণ সমস্যা পোহাতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করছেন, কেউ ভিডিও করছেন, আবার কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করছেন। কেন এসেছেন- এ রকম ১০ জনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘আগুন দেখতে এসেছি।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন পানি ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের কাজ করা অসম্ভব। রাজধানীর পুকুর, খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এজন্য আগুন নেভাতে পানির ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ে। নতুন ভবনে রিজার্ভ পানির ব্যবস্থা রাখার জন্য বারবার বলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আগুন নেভাতে জীবন বাজি রেখে কাজ করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ চ্যালেঞ্জকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় অতিউৎসাহী জনতা। তামাশা দেখতে এসে বিপদ বাড়িয়ে দেয়। আমি দায়িত্বে থাকাকালীন ভিড় ঠেকাতে ক্রাউড কন্ট্রোল টিম করেছিলাম। মগবাজারের অগ্নিকাণ্ডে এ টিম দারুণ কাজ করেছিল। অপ্রয়োজনে এ ভিড় পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তোলে।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ