সারা বিশ্বে পাঁচটি উন্নত দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের জন্য খুব পুরনো ও নির্ভরযোগ্য একটি সমঝোতা চালু আছে, যার নাম ‘ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স’। এই পাঁচ জোড়া চোখের মালিক দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
নিজেদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য— তা সে যতই সংবেদনশীল হোক না কেন, তা পরস্পর শেয়ার করার ব্যাপারে এই দেশগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ। আর সেই রীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে আসছে খুব মসৃণভাবে।
গত সোমবার কানাডার পার্লামেন্টে ভারতের বিরুদ্ধে একটি ‘বোমা’ ফাটানোর আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এই ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্সের শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল, কানাডিয়ান নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় গুপ্তচররা জড়িত বলে কানাডার গোয়েন্দা বিভাগ যে তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে; তা নিয়ে জোটের শরিকরা সবাই মিলে একটি যৌথ বিবৃতি দিক। যাতে ভারতকে সম্মিলিত চাপের মুখে ফেলা যায়।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা বলছে, ‘ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স’ সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তাই এ নিয়ে কোনও যৌথ বিবৃতিও আসেনি। আর সে কারণেই কিনা, কানাডিয়ান পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে ট্রুডো একাই এই অভিযোগ পেশ করলেন। আর যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া বা যুক্তরাজ্যের মতো তার মিত্ররা ‘গুরুতর উদ্বেগ’ ব্যক্ত করার রুটিন বিবৃতি দিয়েই দায় সারলো।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, পার্লামেন্টে দাঁড়িয়েও ট্রুডো বলেছেন, তার সরকার মনে করছে (ওই হত্যায় ভারতের যোগসাজশ থাকার) অভিযোগটি ‘ক্রেডিবল’ বা বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু ওই বক্তব্যের পক্ষে তিনি কোনও প্রমাণ দেননি। এমনকি ভারতের জড়িত থাকার কী সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, তা নিয়েও একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি।
পার্লামেন্টে ট্রুডোর বক্তব্যের পর তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলিও বলেছেন, ‘যদি এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়’, তাহলে সেটা হবে কানাডার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
ফলে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও তার ক্যাবিনেটের সিনিয়র সদস্য; দুজনের কথা থেকেই স্পষ্ট কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা যা-ই তদন্ত করুক, তা এখনও অসম্পূর্ণ। কিংবা তারা যদি আদৌ কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়েও থাকে, সেটাও শেয়ার করার মতো কিছু নয়। ফলে ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্সের শরিকরা কেন এই পর্যায়ে যৌথ বিবৃতি দিতে ‘অস্বীকার করেছেন’, সেটা বোঝাও তাই কঠিন কিছু নয়।
তাহলে কানাডার প্রধানমন্ত্রী বেপরোয়াভাবে কেন একটি বন্ধুদেশের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক অভিযোগ আনতে গেলেন? এই প্রশ্নের জবাবে, কথা বলেন
সাবেক কূটনীতিবিদ, পর্যবেক্ষক ও গবেষক । তাদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, দেশের অভ্যন্তরে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টাতেই জাস্টিন ট্রুডো এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তারা এ-ও বলছেন, এ জন্য কানাডার অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গেও আপস করতে দ্বিধা করেননি ট্রুডো।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. রাধা গুলাটি বলছেন, দেশের ভেতরে ‘শিখ ভোট ব্যাংকে’র কথা মাথায় রেখেই যে ট্রুডো এমন একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ড. গুলাটি বলছিলেন, ‘মনে রাখতে হবে, ট্রুডো কিন্তু একটি মাইনরিটি গভর্নমেন্ট বা সংখ্যালঘু সরকার চালাচ্ছেন। এখন বিভিন্ন দলের শিখ এমপিরা তার সরকারের পাশে দাঁড়ালে ট্রুডো সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, তাই তিনি প্রকাশ্যে খালিস্তানপন্থিদের সমর্থন করতেও দ্বিধা করছেন না।
তিনি আরও জানাচ্ছেন, বস্তুত কানাডার পার্লামেন্টে এখন চতুর্থ বৃহত্তম দল এনডিপি বা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা হলেন জগমিত সিং। যিনি শুধু একজন শিখই নন, প্রকাশ্যে একজন খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থকও বটে। পার্লামেন্টে জগমিত সিংয়ের দলের ২৫টি আসন আছে, আর ট্রুডোর লিবারেল পার্টির এমপির সংখ্যা গরিষ্ঠতার চেয়ে ১০টি কম। ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করাতে ট্রুডো সরকারের ভরসা জগমিত সিংয়ের এনডিপি। আর ফলে প্রধানমন্ত্রীও শিখদের হাতে রাখতে নির্বিচারে ‘খালিস্তানি তাস’ খেলে চলেছেন।
পরিসংখ্যান তুলে ধরে ড. গুলাটি বলেন, ‘শিখরা কানাডার জনসংখ্যার মোটামুটি ২ শতাংশেরও কিছু বেশি। তবে বহু আসনে তাদের ফলাফলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে, কারণ ওই কমিউনিটির লোকজন এন ব্লকে ভোট দিয়ে থাকেন। আর সে কারণেই শিখ-তোষণের রাজনীতি কানাডাতে খুব পরিচিত, ট্রুডো এখন ঠিক যেটা করছেন।’
তবে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই বলছেন, বাকস্বাধীনতা আর আন্দোলনের অধিকারের নামে কানাডা সরকার যেভাবে খালিস্তানপন্থিদের সমর্থন করছে, তা দ্বিচারিতা বা ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। কারণ কানাডাতে সক্রিয় খালিস্তানি নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এমনকি যে হরদীপ সিং নিজ্জারকে নিয়ে এখন এত হইচই; তিনিও ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে ছিলেন। কয়েক বছর আগে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং দিল্লিতে ট্রুডোর হাতে যে সন্ত্রাসীদের নামের তালিকা তুলে দিয়েছিলেন, তাতেও নিজ্জারের নাম ছিল।
কানাডাতে সক্রিয় খালিস্তানপন্থি সংগঠনগুলো
কানাডায় সক্রিয় খালিস্তানপন্থি সংগঠনগুলো বহুবার টরন্টো, অটোয়া বা ভ্যানকুভারের ভারতীয় দূতাবাসের সামনে সহিংস বিক্ষোভ দেখিয়েছে। ১৯৮৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কীভাবে তার শিখ দেহরক্ষীরা হত্যা করেছিল, সেই ঘটনাকে গ্লোরিফাই করে খুব সম্প্রতি কানাডার রাজপথে ট্যাবলো পর্যন্ত বের করেছে খালিস্তানিরা। এর কোনও ঘটনাতেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দেশটির কতৃর্পক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও সাবেক রাষ্ট্রদূত কৃষেণ চন্দর সিং (কে সি সিং নামেই যিনি বেশি পরিচিত) খালিস্তান আন্দোলনের নাড়ি-নক্ষত্র খুব ভালো জানেন। তিনি বলেন, ‘ট্রুডোর পদক্ষেপকে আমার নিছক সস্তা রাজনীতি বলেই মনে হচ্ছে, কারণ পাঞ্জাবে সম্প্রতি এমন কিছুই হয়নি যে খালিস্তানের পক্ষে নতুন করে জনসমর্থন তৈরি হয়েছে। ভারতের ৯৯ শতাংশ বা তারও বেশি পাঞ্জাবি আদৌ নিজেদের জন্য কোনও পৃথক রাষ্ট্র চান না, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।
২০১৫ সালে ভারতের পাঞ্জাবে শিখদের পবিত্র গ্রন্থ ‘সাহিব’ অবমাননার ঘটনা কিংবা তার কয়েক বছর পর কৃষক আন্দোলনের সূত্র ধরে ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ক্ষোভ তৈরি হলেও দেশ ভেঙে পাঞ্জাবকে আলাদা রাষ্ট্র করতে হবে; শিখরা কখনোই এমনটা ভাবেননি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এমনকি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলোতে যে বিশাল শিখ ডায়াসপোরা রয়েছে, তাদের মধ্যেও খুব সামান্য একটা অংশই খালিস্তানের সমর্থক বলে কে সি সিংয়ের ধারণা। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এই মাইনররা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও গুরুদোয়ারাগুলোতে তাদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। কাজেই তাদের কাছে টানার জন্য ওই সব দেশের মূলধারার রাজনীতিবিদরাও সক্রিয়।
সাবেক শীর্ষ কূটনীতিবিদ কে সি সিং এ ঘটনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। তিনি বলেন, ‘খেয়াল করে দেখবেন, ভারতের ডিপ্লোম্যাটদের পশ্চিমা দেশগুলোয় অত্যন্ত সুনাম আছে। তাদের পেশাদারত্ব ও দক্ষতা বহুকাল ধরে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। সেই জায়গায় ভারতের একজন সিনিয়র ডিপ্লোম্যাটকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, তা-ও আবার সেটা করছে জি-সেভেন ও ন্যাটোর সদস্য একটি দেশ। আমি বলবো এটা বিরলের মধ্যে বিরলতম একটি ঘটনা।’
ফলে পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই বক্তব্য ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগটি প্রকাশ্যে এনে কানাডা বিষয়টি এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছে, কূটনীতির ভাষায় যেটাকে বলে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। সোজা কথায় যেখান থেকে পুরনো স্বাভাবিক বন্ধুত্বে ফিরে আসাটা খুব মুশকিল।
এই মূল্যায়নে সায় দিয়ে এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো ড. ঋষি গুপ্তা বলেন, ‘এটা বোঝাই যাচ্ছে যে কানাডা সরকার ভারতের সঙ্গে তাদের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ককে আদৌ গুরুত্ব দিতে চাইছে না। যে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা অবাধ বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দুই দেশের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল, সেই আলোচনা পর্যন্ত তারা এককথায় দুম করে বন্ধ করে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে ভারতের একটা বড় আকর্ষণ হলো সে দেশের বিপুল বাজার। সেই সঙ্গে ভারতের শ্রমসম্পদ ও অগাধ বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। ঋষি গুপ্তা মনে করছেন, স্রেফ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে ট্রুডো সরকার তার দেশের এই স্বার্থগুলোর সঙ্গেও আপস করতে পিছপা হচ্ছে না।
জাস্টিন ট্রুডো রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে এই ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করলেও পশ্চিমা বিশ্বে তিনি নিজেদের শরিকদের কতটা পাশে পাবেন, তা নিয়েও অবশ্য প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
বিশেষত বর্তমান ভূরাজনীতিতে চীনকে মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে ভারতকে দরকার, তা সুবিদিত। বাইডেন প্রশাসনও এটা নিয়ে কখনও লুকোছাপা করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া উভয়েই ভারতের সঙ্গে কোয়াড জোটেরও শরিক (যাতে জাপানও আছে); সেখানে তারা ভারতের বিরুদ্ধে কতটা কঠোর অবস্থান নেয়, সেটা অবশ্য দেখার বিষয়। ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স প্রথম ধাপেই এই ঘটনাতে যৌথ বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছে। পরে কানাডা কোনও অকাট্য প্রমাণ পেশ করতে না পারলে তারা যে বিষয়টা নিয়ে বেশি এগোতে চাইবে না (মিত্র দেশ ভারতকে চটাতে চাইবে না), সেটাও সহজবোধ্য।
দিল্লির থিংকট্যাংক ওআরএফে ফরেন পলিসি নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ। তিনি বলেন, ‘বিষয়টাকে জাস্টিন ট্রুডো তার একটা ব্যক্তিগত লড়াইয়ের চেহারা দিয়ে দিয়েছেন। সে জন্যই আমার ধারণা বিষয়টা শেষ পর্যন্ত কানাডা-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিসরেই থেকে যাবে, ‘ওয়াইডার ওয়েস্ট’ বা বৃহত্তর পশ্চিমা বিশ্ব তাতে নিজেদের জড়াতে চাইবে না। কারণ তাতে ভারতের সঙ্গে তাদের যে আলাদা স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ, সেটা অযথা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।’